অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে এক কমিটিতে চলছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রম। দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ার ফলে দলের সার্বিক কর্মকাণ্ড যেমন ঝিমিয়ে পড়েছে তেমনি সাংগঠনিক চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেছে। ৭ বছরে ৩০ বারের বেশি মারামারি, লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আলোচনার শীর্ষে ছিল এই কমিটি। এসব ঘটনায় দৃশ্যমান কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা।
ছাত্রলীগের একাংশের দাবি, ‘সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মদদেই এসব অপকর্ম করছে তাদের অনুসারীরা।’ তবে ছাত্রলীগের কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে খোঁজ-খবর নিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রে সবসময় সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান বর্তমান কমিটির সভাপতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র নেতারা জানান, দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ার ফলে সাংগঠনিক চেইন বলে কিছু নেই। বর্তমান কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে তারা কীভাবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বরং কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মদদেই এসব মারামারি হয়েছে। অধিকাংশ মারামারিতে তাদের কাছের কর্মীরা জড়িত থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ২৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরে ১১ ডিসেম্বর গোলাম কিবরিয়াকে সভাপতি ও ফয়সাল আহমেদ রুনুকে সাধারণ সম্পাদক করে রাবি ছাত্রলীগের ১৩ সদস্যের প্রাথমিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিক কমিটির প্রায় ছয় মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২০১৭ সালে এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। কমিটি পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সময় ছোট-বড় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে নেতাকর্মীরা।
আরও জানা যায়, গত ২৩ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির জন্য জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। প্রায় সপ্তাহ না যেতেই আরেক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১২ নভেম্বর রাবি শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় কমিটি। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার শেষ সময়। ৯৪ জন প্রার্থী জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। পরবর্তীতে কোনো এক অজানা কারণে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৭ বছরে শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ৩০ বারের বেশি মারামারির ঘটনা ঘটেছে। যেসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী নানাভাবে আহত হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরের মধ্যে মার্চ মাসে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। তবে এই মারামারির মূলে ছিল ছাত্রলীগ। এসব ঘটনায় মাত্র ৬ জন ছাত্রলীগের নেতাকে বিভিন্ন সময় সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তবে পরবর্তীতে আবার ৩ জনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে সংগঠনটি। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫ লাখের বেশি টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে।
মারামারির অভিযোগ :
গত মঙ্গলবার রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয় অন্য দুই ছাত্রলীগ নেতা। এ ছাড়া চলতি বছরের গত ২৭ মে শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে মারামারি ও অস্ত্রের মহড়া হয়। গত ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলের সামনে মোটরসাইকেলের ওপর হাত রাখা নিয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে ছাত্রলীগের মধ্যে মারধরের ঘটনা ঘটে। গত ১৭ মার্চ ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় সমাজকর্ম বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাফায়েত হোসেনকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। গত ১১ মার্চ সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়।
আরও জানা যায়, ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে মতিহার হলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মারামারিতে ছাত্রলীগ নেতাসহ তিনজন আহত হয়েছেন। গত ২৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। গত ২৯ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলের টিভি রুমে ধূমপান করতে নিষেধ করায় সাংবাদিককে মারধর করা হয়। গত ৩১ মে বিকেলে জাম পাড়াকে কেন্দ্র ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে ৩ জন আহত হয়। গত ১৩ মে হলে সিট নিয়ে ঝামেলায় শাহ্ মখদুম হলের সভাপতি তাজবীউল হাসান অপূর্বকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতের অভিযোগ ওঠে। গত ২৪ জুন গভীর রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলের শিক্ষার্থী মো. মুন্না ইসলামকে মারধর করে বের করে দেয়। গত ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আল-আমিন নামের এক শিক্ষার্থীকে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। গত ১৯ আগস্ট মতিহার হলে চাঁদা না দেওয়ায় অর্থনীতি বিভাগের সামছুল ইসলামের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা। ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীকে ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে নির্যাতন। ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুরের অভিযোগ। ২০২১ সালের ৬ মে রাজশাহী মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়। ২০২০ সালের ০৬ ফেব্রুয়ারি দুই শিক্ষার্থীকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগ সহসভাপতি রুহুল আমিন কিস্কুসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলের গেস্টরুমে বসাকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মী আহত হয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় এক শিক্ষার্থী পঙ্গু হওয়াসহ বেশকিছু শিক্ষার্থী আহত হয়। ৬ ডিসেম্বর তারিক হাসান নামের এক শিক্ষার্থীর মাথা ফাটিয়ে দেয় ছাত্রলীগের গুফরান গাজী।
চাঁদাবাজি:
২২ সালের ২৫ জুলাই ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা বাস থেকে ৪০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি, ১১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে গ্রামীণ টেলিকম থেকে ৫০ হাজার টাকা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে শহীদ জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. রাশেদ খান ও হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোহাগের বিরুদ্ধে। এর আগে ৬ আগস্ট ২০ তলা একাডেমিক ভবনের কাজ চলাকালে শহীদ হবিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করার অভিযোগ ওঠে। গত জুনের শেষ সপ্তাহে তিনি ওই ভবন নির্মাণকাজে নিয়োজিত ঠিকাদারের কাছ থেকে ৩৪ হাজার টাকা চাঁদা নেন বলেও অভিযোগ করেন একজন সহকারী প্রকৌশলী। এ ছাড়া আরও বেশকিছু জায়গা থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে নির্যাতিত হওয়া এক শিক্ষার্থী জানান, ‘হলের মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় চাঁদা দাবি করা হয়।’
শাখা ছাত্রলীগের উপধর্মবিষয়ক সম্পাদক তৌহিদ দুর্জয় বলেন, ‘বিভিন্ন মারামারির ঘটনায় সভাপতি ও সম্পাদকের অনেক কাছের কর্মীরা জড়িত থাকেন। সাংগঠনিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। ফলে তারা আবারও এমন ঘটনা ঘটায়। অনেক সময় এসব ঘটনায় সভাপতি ও সম্পাদকের মদদও থাকে।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মারামারির ঘটনায় অনেক সময় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি অথবা সম্পাদকের কর্মীরা জড়িত থাকেন তাই তাদের বিরুদ্ধে সেভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেন না।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে আমি ও সাধারণ সম্পাদক ব্যক্তিগতভাবে সত্যতা যাচাই করি। কারণ তদন্ত কমিটি করলে অনেক সময় পক্ষপাতিত্ব হতে পারে। সব অভিযোগে যে ছাত্রলীগ জড়িত থাকে তেমন নয়। অনেক সময় ছাত্রলীগকে জড়িয়ে কূটকৌশল অবলম্বন করা হয়। এসবের জন্য আমরা সভা করেছি। ছাত্রলীগের মধ্যে কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। সব অভিযোগের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে আমরা সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
সৌজন্যে: দৈনিক কালবেলা।