মরমিবাদ | জাহান আরা খাতুন

:: জাহান আরা খাতুন ::
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

মরমিবাদ বিষয়ে’ মরমি কবি পাঞ্জু শাহ: জীবন ও কাব্য’ গ্রন্থে ডক্টর খোন্দকার রিয়াজুল হক বহু বিদ্বান ও প্রাজ্ঞজনের মতামত বিবৃত করেছেন। কয়েকটি আমরা চয়ন করেছি।
‘‘মরমিবাদ” ইংরেজী মিস্টিসিজম (Mysticism)  শব্দের বাংলা রূপান্তর।১ মরমি বলতে অস্পষ্ট গূঢ় অর্থপূর্ণ গুপ্ত রহস্যমণ্ডিত   হৃদয় দ্বারা অনুভূত বিষয় বুঝায়। স্রষ্টার সাথে প্রত্যক্ষ সংযোজন স্থাপনে সক্ষম ব্যক্তিকেও মরমি বলা হয়।২ অর্থাৎ পরম সত্যের সাথে যাঁর মর্ম বা অন্তঃকরণ সংযুক্ত তিনিই মরমি এবং দার্শনিক প্রমাণাদি দ্বারা নির্ণীত তাঁর সিদ্ধান্ত বা মানসতত্ত্ব মরমিবাদ নামে অভিহিত।৩  আঞ্চলিক ভাষায় মরমি অর্থে মরমিয়া কথাটি প্রচলিত। মরমিয়া সেখানে পবিত্র হৃদয় বিশিষ্ট সমবেদনা অনুভবকারী৪ মহাপ্রাণ ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক শব্দ। তবু মনে হয়, অতিন্দ্রীয়- এই প্রতিশব্দ দ্বারা মরমি শব্দটি অধিকতর তাৎপর্যময় হয়ে উঠে। কেননা ইন্দ্রিয়ের অগম্য বা জ্ঞানের অবিষয়ীভূত যা কিছু, তা-ই অতিন্দ্রীয়; মর্মদ্বারা উপলব্ধি ব্যতীত যার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবন সম্ভব নয়।৫ বস্তুত মর্মদ্বারা অনুভূত তত্ত্ব বলে ‘‘মরমিবাদ” ইন্দ্রিয়াতীত অব্যক্ত রহস্যলোকের গূহ্যবস্তু-জ্ঞানাতীত চিন্তাতীত আত্মিক বিষয়।৬ সুতরাং প্রেমমিশ্রিত ধ্যান ও স্বজ্ঞা বা বোধি দ্বারা পরমসত্তার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের অভিজ্ঞতাই ‘‘মরমিবাদ।”৭
…বস্তুত অন্তরের গভীরে উপলব্ধ সত্য-শিহরণের অনুভূতি বোধি (স্বজ্ঞা) ব্যতীত জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা ও প্রজ্ঞা দ্বারা বিচার্য নয়। কেননা একমাত্র বোধিদৃষ্টির ফলেই সমুচ্চ অনন্ত সত্তার সাথে শান্ত মানব সত্তার বিভেদ তিরোহিত হয়।৪ সীমাবদ্ধ জ্ঞানে শ্রেয়-প্রেয় সেই অসীমকে জানা অসম্ভব। বিজ্ঞানও এ জানাকে সম্ভব করতে পারে না। কারণ জানা (Knowing) এবং হওয়া (becoming) অভিন্ন-অচ্ছেদ্য হয়ে একটি চরমাবস্থা সৃষ্টি করে। ধ্যানদৃষ্টিসম্ভূত সে চরমাবস্থার কথা বিজ্ঞান ভাবতেই পারে না। যোগী যা ধ্যানে এবং কবি যা ভাবে পেয়ে থাকেন, সেই অহংবিলুপ্ত তন্ময়াবস্থা মরমির ব্যক্তিগত অনুভূতি। শ্রুতি যাকে পরাবিদ্যা বলে, এটা আসলে তাই।৫ মরমিবাদের চূড়ান্ত তাৎপর্য এই।
দৃষ্টি বহির্ভূত অতীন্দ্রিয় জগৎ এবং শাশ্বত অধ্যাত্ম প্রেম চিরন্তন। মরমিরা এ চিরন্তনবাদে আস্থাশীল।১ এই আস্থা অর্জনের প্রধানতম অবলম্বন হচ্ছে আত্মা। সুতরাং আত্মাই মরমিবাদের প্রধান উৎস।
মানুষ যে উৎস থেকে এসেছে, সে উৎসে ফিরে যাবে। আল-কোরআনে এ কথার উল্লেখ আছে।২ গ্রীক ও নিউপ্লেটোনিক দার্শনিকগণও এ তত্ত্ব সমর্থন করেন।৩ কি ও কোথায় সে উৎস, যাঁর কাছ থেকে এ জীব জগতের যাত্রা শুরু হয়েছে এবং দীর্ঘপথ-পরিক্রমার পর একদিন তাঁর সাথে জীবের মিলন হবে? এ প্রশ্নের জবাব-সন্ধানী ‘উৎকণ্ঠা’ মরমি চিন্তার আর একটি উৎস।
নশ্বর এ দেহে অবিনশ্বর সত্তার বসত। বাইরে না খুঁজে আপন দেহমধ্যে খোঁজ করলে তাঁকে পাওয়া যায়। মরমি মনের এ আত্ম-অনুসন্ধান স্পৃহা থেকে মরমিবাদের উৎপত্তি।… ধর্মের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান নয়, হৃদয়ের প্রেমই স্রষ্টাকে লাভ করার শ্রেষ্ঠতম উপায়। এ প্রেমানুভূতি থেকে মরমিবাদের ধারা-প্রবাহ সৃষ্ট। জগতের অনেক মরমির জীবন-দর্শন, বাণী ও আদর্শ এ কথার সাক্ষ্য বহন করে।৫… অজ্ঞাতকে পরিজ্ঞাত হবার আকাঙ্ক্ষা, চর্ম চক্ষে দৃষ্ট বস্তুর পশ্চাতে লুক্কায়িত অদৃশ্য বস্তুকে প্রাণের নয়নে মর্মের দৃষ্টিতে দেখার ও বুঝার তীব্র আন্তর-প্রেরণা থেকে মরমিবাদের উদ্ভব।১
প্রত্যেক ধর্ম-উদ্ভবের মূলে থাকে দুটি প্রবণতা। একটি মানুষকে মর্মমুখ করে অজানার সন্ধান বলে দিতে চায়। অন্যটি তাকে কর্মমুখ করে বাইরের সভ্যতা ও জ্ঞানের দিকে চালিত করে। ধর্ম ও কর্ম উভয়দিকে ঝোঁক পড়লে ধর্মানুসারীদের মধ্যে একটা অতিরঞ্জনের সংঘাত আসে। ফলে ঐহিকতার চাপে মর্মের দিকটা নির্বাণোন্মুখ প্রদীপের মতো হয়ে পড়ে। এরই শেষ শিখাটুকুকেই মরমিবাদের উদ্ভবের মূলে দেখতে পাই।২
প্রাচীন বিশ্বের কোথায় সর্বপ্রথম মরমিবাদের উদ্ভব ঘটে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বিদ্বানদের মতে, মরমিবাদ অনেক ধর্মীয় বিশ্বাসেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাচ্যের আদিম ধর্মমতসমূহ, বৈদিক সাহিত্য, চীন-ভারতের বুদ্ধমত, ইহুদী মতবাদ, গ্রীক মতাদর্শ, খ্রীস্টীয় ধর্মবিশ্বাস এবং বিশেষ করে ইসলামে এর প্রভাব সর্বাধিক। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগেই মরমিবাদ ইসলামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মুসলিম দেশসমূহে বিস্তৃত হয়। তবে মিশর, পারস্য, তুরস্ক ও ভারত মরমিবাদ-প্রভাবিত দেশ হিসেবে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।৩
ঐতিহাসিকেরা বলেন-ভারতের চিন্তা জগতে অধ্যাত্মবাদের প্রভাব সর্বজনবিদিত।৪ বিশ্বকোষের তথ্য থেকেও দেখা যায়, ‘‘ভারতের সমাধিমগ্ন যোগিদের সাধন-মার্গ মরমি ভাবধারার সাথে অভিন্ন।”৫
…প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস (খ্রীস্টপূর্ব ৪৬৯-খ্রীস্টপূর্ব ৩৯৯) তাঁর তত্ত্বদর্শনে আত্মাকে বৌদ্ধিক ও নৈতিক দায়িত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত বলে প্রমাণ করেন। জগৎ সৃষ্টি ও পরিচালনার পশ্চাতে একটি পরম বুদ্ধিমান সত্তার অস্তিত্ব আবিষ্কার তাঁর তত্ত্বচিন্তার ফল। তাঁর মতে, এ সত্তাই হচ্ছে জ্ঞানবান ঈশ্বর। আত্মার অমরত্ব ও দেহের নশ্বরত্ব সম্পর্কেও তাঁর মত ছিল খুব স্পষ্ট। পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণের মধ্যে তিনিই প্রথম আত্মতত্ত্ব সন্ধানী। ‘নিজেকে জানো’ (knoweth thyself) এ আদেশবাণী তিনিই প্রথম উচ্চারণ করেন। বস্তুত মানবকল্যাণে সক্রেটিসের মরমি ভাষ্য অপূর্ব ও অসাধারণ।৩
সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৪২৭—খ্রীস্টপূর্ব ৩৪৭) চিন্তাজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ভাববাদী এই চিন্তাবিদ নিত্য পরিবর্তনশীল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিদৃশ্যমান এ জগতকে অলীক ও অসার বলে উল্লেখ করেন। তাঁর ধারণায় অদৃশ্য-অতীন্দ্রিয় যা, তা-ই নিত্য সত্য। ঈশ্বরবাদী এ মনীষীর মতে, ‘প্রকৃত তত্ত্বের নিগূঢ় মর্ম উপলব্ধি স্বল্প সংখ্যক লোকের পক্ষেই সম্ভব।’৪…
…মানুষের সাথে জগৎ ও ঈশ্বর কিভাবে সম্পৃক্ত তাঁর একটি সুসংহত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় প্লোটিনাসের মরমি দর্শনে। তাঁর মতে, ঐশীজ্ঞানের পরিণতি পরোক্ষ অনুভূতি, দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণ নয়। দেবতা কোন মন্দিরে থাকেন না, তিনি থাকেন মানুষের হৃদয়ে। এ হচ্ছে তাঁর মূল বক্তব্য। আত্মা অবশ্যই ঈশ্বরের সাথে পুনর্মিলিত হবে। একথা তিনি স্পষ্ট করে বলেন। আত্মশুদ্ধির দ্বারা পরিশুদ্ধ হলে আত্মা আর পুনর্জন্মের ফেরে পড়ে না। এসব তত্ত্ববিচারে প্লোটিনাসকে মরমি ভাবনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক বলা যায়…।৩..
মুসলিম দর্শনে মরমিবাদের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। ইসলামে নিহিত ‘‘মরমি-বাদ” বস্তুত ‘‘সুফীবাদ” নামেই পরিচিত। আর ইসলামী সুফীবাদই বিশ্ব-মরমিবাদের শ্রেষ্ঠতম বিকাশ।১।” পৃ ১_১৬

এ বিষয়ে ডক্টর আহমদ শরীফ রচিত ‘বাংলার সুফী সাহিত্য ‘গ্রন্থ থেকে জানা যায়, “তাত্ত্বিকও মরমিয়া হলেও সুফিরা ইসলামকে ভুলেনি। কোরআনের সমর্থনকেই সম্বল করে জীবন ও ধর্মকে সমন্বিত  করবার চেষ্টা করেছে। মুসলমানদের সাধারণ বিশ্বাস রসূল জীবনে তাত্ত্বিক  তথা  মরমিয়াও ছিলেন। এবং তাঁর প্রিয় সহচর আলী ও আবুবকরকে এই তত্ত্বে দীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি।   …”আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশের জ্যোতিস্বরূপ। উটের দিকে তাকিয়ে দেখ, কি কৌশলে তা সৃষ্টি হয়েছে। আকাশের মহিমা দেখ, পর্বতগুলো কেমন দৃঢ় করে স্থাপন করেছেন।  বল তা হচ্ছে আল্লাহর আদেশ বা শক্তি। “কুরআনের এসব আয়াতের তাত্ত্বিক  ব্যাখ্যার উপরেই  সুফীবাদের ইসলামী রূপ প্রতিষ্ঠিত।
“( পৃ ২১)

ডক্টর দুলাল চৌধুরীর প্রবন্ধেও একই কথার গুঞ্জরণ শোনা যায়, ” সুফী সাধকের অ অনুধ্য নের প্রথম ও প্রধান বিষয় হল কোরআন।তাঁর দিবারাত্রির কাব্য হল : ঈশ্বর স্মরণ ও পরম শান্তি লাভ।” (ফোকলোর, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা,  পৃ২৯)
‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ গ্রন্থে ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য  প্রাচীন যুগের সুফিদের বিষয়ে বলেন,”  “সূফিগণ সংসার বিমুখতা ও দারিদ্র্য ঈশ্বর লাভের উপায় স্বরূপ মনে করিয়াই গ্রহণ করিত।
ক্রমে সূফিগণ বাহ্য অনুষ্ঠান ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরে প্রগাঢ় ভক্তি, নিরন্তর ঈশ্বর ধ্যান , ঈশ্বরে পূর্ণ আত্মসমর্পণ প্রভৃতির উপরেই মনোযোগ দেয়। এই  প্রাচীন যুগের সূফীগণ কোরআন ও হাদিসের বাণীকে অকাট্য  বলিয়া গ্রহণ করিত এবং শরীয়ত নির্দিষ্ট আচার  আচরণ  পালন করিত। ক্রমে ঈশ্বর প্রেমকেই ধর্মের ভিত্তি করা হয় । ” পৃ৪৮৪-৪৮৬।
স্বনামধন্য সুফি রাবেয়ার  সময় থেকেই সুফি মতবাদে নবযুগের সূচনা খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর প্রথমদিকে।
শুরুতে এ মতবাদ ভারতীয় বৌদ্ধ ও বেদান্তদর্শন, নিউ প্লেটোনিক দর্শন, প্লটিনাস মতবাদ, খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসবাদ ও অতীন্দ্রিয়বাদ, নস্টিক  মতবাদ, পারসিক ভাবধারা প্রভৃতির প্রভাবে কিছুটা প্রভাবিত  বলে অনেক পণ্ডিত অনুমান করেছেন।
তবে কোরআনের একেশ্বরবাদের প্রভাবযে এ নতুন সুফিবাদের মূল সুর, এ বিষয়ে কেউ  দ্বিমত পোষণ করেননি।

 

লেখক: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]