ভিসার দীর্ঘসূত্রতা: অবৈধ পথ বেঁছে নিচ্ছেন ভিসা প্রার্থীরা

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

জীবনমান উন্নয়ন, ভালোয় আয়ের আশায় বিপুলসংখ্যক লোকজন ইউরোপে দেশ ইতালিতে পাড়ি দিচ্ছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ভিসা পেতে দীর্ঘ সময় লাগায় ভিসাপ্রত্যাশীরা বেঁছে নিচ্ছেন অবৈধ পথ।

এমন পরিস্থিতিতে ইতালির বর্তমান শ্রমবাজার ইস্যু নিয়ে দেশের স্বনামধন্য একটি পত্রিকায় কথা বলেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী।

দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন করছেন, তাদের একটা অংশ পরে ইউরোপে যেতে চায়।

দেশে ফিরে এসে যাঁরা ইউরোপে যেতে চান, কিংবা দেশে যাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভালো তারা ইতালি হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে চান। তাঁরা যে ইতালিতে যেতে চাচ্ছেন তা কিন্তু না, ইতালি হয়ে তাঁরা ইউরোপের অন্য দেশে যেতে চান। আবার ইতালিতেও আমাদের দেশের কর্মীদের চাহিদা রয়েছে।

তিনি বলেন, বিশেষ করে কৃষিকাজে, ফল তোলায় আমাদের কর্মীদের চাহিদা বেশ। এই শ্রমবাজার ধরতে দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। একটি হচ্ছে, ওই দেশ থেকে স্বল্পকালীন ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে আনা, এটি এক বছরের জন্য করা হয়। কিন্তু আমরা দেখছি যাঁরা দেশটিতে যেতে চাচ্ছেন তাঁদের যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসার দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। আর যাঁরা অনিয়মের পথ ধরে যাচ্ছেন তাঁরা দালালদের অর্থ দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে চলে যাচ্ছেন। অথচ যাঁরা বৈধভাবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে ইতালি যেতে চান, তাঁদের ক্ষেত্রে ভিসার এই দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। বৈধ পথে অভিবাসনের জন্য এটি একটি বড় অন্তরায়। এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য অনেক সময় বৈধ পথে যাওয়া ব্যক্তিদের ওয়ার্ক পারমিটের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ইউরোপের বেশির ভাগ রাষ্ট্র ভিএফএসের মাধ্যমে ভিসা প্রসেস করে। ভিএফএসের কাজ হচ্ছে কর্মীদের কাছ থেকে কাগজপত্র গ্রহণ করা। এরপর কাগজপত্র সঠিক থাকলে তাদের যে পক্রিয়া রয়েছে সেই পক্রিয়া অনুযায়ী সেগুলো দূতাবাসে পাঠিয়ে দেওয়া এবং ফেরত আনা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে যেতেই পারছেন না। এর কারণ ভিসার মেয়াদ এক বছর। কিন্তু দীর্ঘসূত্রতার কারনে ছয় থেকে আট মাস পাসপোর্ট আটকা থাকছে। এ ছাড়া ভিএফএস যে চার্জ নিচ্ছে ওই চার্জের বিষয়েও কথা রয়েছে। ভারত বা নেপালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশে চার্জ অনেক বেশি। এই চার্জ কমাতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব কারণে অবৈধ অভিবাসন তৈরি হচ্ছে। আমাদের কর্মীরা ইউরোপের বাজারগুলোতে যেতে চান, কিন্তু ভিসার দীর্ঘসূত্রতায় আটকা পড়ে তাঁরা অবৈধ পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এই দীর্ঘসূত্রতায় আমরা কী পরিমাণ রেমিট্যান্স হারাচ্ছি? এমন প্রশ্নে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে আমরা প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাচ্ছি। বর্তমানে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে আমেরিকা, ইউরোপ ও ইতালি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যদি আমরা এসব রাষ্ট্রে আমাদের শ্রমবাজারকে ঢেলে সাজাতে পারতাম, তাহলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়ত। বৈধ পথে যাওয়ায় অনেক রকম অসুবিধার ফলে যাঁরা অবৈধ পথে যাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু অবৈধ পথেই টাকা পাঠাচ্ছেন। আমাদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হার বৃদ্ধি না পাওয়ার পেছনে রয়েছে অব্যবস্থাপনা।

ইউরোপের বাজারে শুধু ভিএফএস গ্লোবাল কাজ করছে। এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় আছে কি?

প্রশ্নের উত্তরে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের করার কিছু নেই। কারণ যে দেশে আমরা যেতে চাচ্ছি সেই দেশগুলো ভিএফএস গ্লোবালকে কাজটা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যে অসুবিধাগুলো রয়েছে সেই অসুবিধাগুলো যদি সরকারের সামনে তুলে ধরা যেত তাহলে হয়তো কিছুটা সমাধান সম্ভব হতো।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? প্রশ্নের উত্তরে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এ ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকার বিএমইটিকে বলতে পারে ইতালি দূতাবাসকে চিঠি দিয়ে বিষয়গুলো তদন্ত করে দ্রুত সমাধান করতে। সরকার চাইলে অবশ্যই এর প্রতিকার সম্ভব।

অন্য দেশে সাত দিনে ভিসা পাওয়া যাচ্ছে, বাংলাদেশে এত দেরি হওয়ার কারণ কী? উত্তরে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এর উত্তর ভিএফএসের কাছে থাকতে পারে, কেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এত বিলম্ব হচ্ছে। কাগজপত্র পরীক্ষা করে জমা নিলে তো বিলম্ব হওয়ার কারণ নেই। ভিএফএস গ্লোবালে যাওয়ার পর ওরা বলে দিচ্ছে, এই কাগজ ঠিক আছে তো এই কাগজ ঠিক নেই। সব ডকুমেন্ট পরীক্ষা করে তারা সেটা দূতাবাসে পাঠায়। পাসপোর্ট দূতাবাস থেকে ফেরত আসার পর সেটি আর তাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।

তাসনিম সিদ্দিকী প্রশ্ন করা হয়, দীর্ঘসূত্রতার জায়গাটা কোথায়? উত্তরে তিনি বলেন, একটি কারণ হচ্ছে, দূতাবাস যে বলছে গড়ে চারটি ভিসা আবেদনের মধ্যে একটি আবেদনে ওয়ার্ক পারমিট ভুয়া। আরেকটি কারণ হচ্ছে ভিএফএস গ্লোবালের গুরুত্বহীনতা। ভিসা কখনো এক বছর আটকে থাকে না। এর কোনো যুক্তি নেই। এখানে অনলাইন ট্র্যাকিংকে কার্যকর করতে হবে। তাহলে জানা যাবে কেন এবং কোথায় এই পাসপোর্টগুলো আটকে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা অনেক মানুষ এই দীর্ঘসূত্রতায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, এর ফলে সেখানকার শ্রমবাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি?

তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, আমাদের ভিসা রেজিম বলে, কেউ যদি বিদেশ যেতে চান তাহলে বাংলাদেশে ফিরে এসে তাঁকে আবেদন করতে হবে। আরেকটি দেশে থেকে সে আবেদন করতে পারবেন না। এর ফলে যাঁরা ইতালি যেতে মধ্যপ্রাচ্য বা সৌদি আরব থেকে এসে আবেদন করলেন কিন্তু ইতালি কিংবা আগের দেশে আর যেতে পারলেন না, এতে কিন্তু ওই ব্যক্তির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। ব্যক্তির এই ক্ষতির কথা সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে এটি খুব দুঃখজনক ব্যাপার দাঁড়ায়। এটি আমাদের রেমিট্যান্সের ওপর নেতিকবাচক প্রভাব বিস্তার করবে।