ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন যেভাবে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে

::
প্রকাশ: ২ years ago

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হল ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ডিজেল পাইপলাইন। পাইপলাইনটি বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির মধ্যে ১৩০ কিলোমিটার ব্যবধান জুড়ে বিস্তৃত হবে। পাইপলাইনটি দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সম্পর্ক জোরদার করবে এবং বাংলাদেশকে বার্ষিক ২ মিলিয়ন টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন পেট্রলের নির্ভরযোগ্য উৎস সরবরাহ  করবে।

১৮ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন’ উদ্বোধনকে দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি মাইলফলক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি এই মেত্রী পাইপলাইন আমাদের দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যে সহযোগিতা উন্নয়নের একটি মাইলফলক অর্জন।’

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

ভারতীয় লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) থেকে নেওয়া প্রায় ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ভারতীয় রুপি ব্যয়ে নির্মিত ১৩১ দশমিক ৫ কি.মি ভারত-বাংলাদেশ  মৈত্রী পাইপলাইনের (আইবিএফপিএল) মাধ্যমে বাংলাদেশে ডিজেল রপ্তানি করবে ভারত। ভারতের শিলিগুড়ির নুমালীগড় রিফাইনারী থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পাইপলাইনে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর ডিপোতে ডিজেল আমদানি করা হবে। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশে পড়েছে প্রায় ১২৫ এবং ভারতের অংশে প্রায় ৫ কিলোমিটার। পাইপলাইনটির হাই-স্পিড ডিজেল (এইচএসডি)-এর বার্ষিক পরিবহনের ক্ষমতা ১ (এক) মিলিয়ন মেট্রিক টন (এমএমটিপিএ)।

পাইপলাইনটি উদ্বোধনের পর উভয় প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন যে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি, পারস্পরিক সুবিধার জন্য দেশ দুটির মধ্যে কানেকটিভিটি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার উপরও তাঁরা জোর  দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি বাংলাদেশের জ¦ালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। শেখ হাসিনা বলেন, ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। আমাদের দুই দেশের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সেটাই আমি চাই।

তিনি বলেন, এই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন চালুর ফলে বাংলাদেশের জনগণ নানাভাবে উপকৃত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যখন বিশে^র অনেক দেশ জ¦ালানি সংকটের মুখোমুখি তখন এই পাইপলাইনটি আমাদের জনগণের জ¦ালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আমদানীতে ব্যয় এবং সময়ও উল্লেখযোগ্য ভবে হ্রাস পাবে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন,  এই পাইপলাইন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী পাইপলাইন নির্মাণে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের জন্য ভারত সরকার এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রীসহ আসামের জনগণের প্রতিও ধন্যবাদ জানান

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আজ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।’

নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এর উদ্বোধন করতে পেরে আমি আনন্দিত। আরও সন্তুষ্টির বিষয় হচ্ছে, করোনা মহামারির সময়েও এই প্রকল্পের কাজ চলমান ছিল। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন হাইস্পিড ডিজেল পৌঁছানো যাবে।’

তিনি বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ খরচ তো কমবেই, একইসঙ্গে এই সরবরাহে কার্বন নিঃসরণও কম হবে। বিশ্বস্ত ডিজেল সরবরা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন প্রকল্পটি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার যে ভিশন, তার একটি ‘উত্তম উদাহরণ’ বলেও মন্তব্য করেন নরেন্দ্র মোদি। হ কৃষিক্ষেত্রের জন্য লাভজনক হবে। স্থানীয় ব্যবসাও এর মাধ্যমে লাভবান হবে।’

পাইপলাইনটি বছরে এক মিলিয়ন মেট্রিক টন উচ্চ গতির ডিজেল (এমএমটিপিএ) (এইচএসডি) স্থানান্তর করতে পারে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সাতটি জেলায় উচ্চগতির ডিজেল সরবরাহ করা হবে।

পাইপলাইন প্রকল্পটি বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছে এবং এর উদ্বোধন ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট উপস্থাপন করে। এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংযোগকে আরও দৃঢ় করার ক্ষমতা রাখে এবং এটি তাদের ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস এবং সহযোগিতার একটি স্পষ্ট লক্ষণ।

পাইপলাইনের পরিবহন খরচ হ্রাস এবং জ্বালানী দক্ষতা বৃদ্ধি এর দুটি প্রধান সুবিধা। বাংলাদেশ এখন সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে উচ্চ পরিবহন ব্যয়ে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করে।

পাইপলাইনের জন্য বাংলাদেশে আরও সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প থাকবে, যা শেষ পর্যন্ত দেশের গ্রাহকদের সহায়তা করবে। এই পাইপলাইন বাংলাদেশকেও শক্তির নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে গড়ে তুলবে, যা পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হয়েছে। তার শক্তির চাহিদা মেটাতে, জাতি প্রাথমিকভাবে কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভর শীল, তবে সরবরাহ ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে লড়াই করেছে। পাইপলাইনটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিকল্প জ্বালানী সরবরাহ করবে, যা দেশের জ্বালানি সংকট কে প্রশমিত করবে।

উপরন্তু, পাইপলাইনটি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বিশেষত জ্বালানি খাতে উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই পাইপলাইনের ফলে বাংলাদেশে উচ্চমানের জ্বালানির ধারাবাহিক উৎস থাকবে, যা পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহকারী ভারত থেকে আসবে। ভারতের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে পারে বাংলাদেশ সে দেশে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ রফতানি করে। এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক সংযোগকে শক্তিশালী করবে এবং নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করবে।

পাইপলাইনের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে উভয় দেশই উপকৃত হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে ভারত লাভবান হবে এবং নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানি সরবরাহের সুযোগ থেকে বাংলাদেশ লাভবান হবে। উপরন্তু, পাইপলাইনটি উভয় দেশে বিশেষত পাইপলাইন নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।

তবুও, পাইপলাইনের সুবিধাজনক প্রভাব সত্ত্বেও, প্রকল্পের সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ রয়েছে। পাইপলাইনটি নির্মাণ এবং পরিচালনাবন এবং জলাভূমির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যা পাইপলাইনটি অতিক্রম করে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে প্রকল্পটি এমনভাবে পরিচালিত হবে যা পরিবেশবান্ধব এবং স্থানীয় জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।

এই পাইপলাইনভারত ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কে এগিয়ে নিতে তাদের অঙ্গীকারের একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন। এটি নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত করতে পারে এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংযোগ জোরদার করার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

পাইপলাইন প্রকল্পটি ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও ভারত সহযোগিতা করে যাচ্ছে। চীন দক্ষিণ এশিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। পাইপলাইন প্রকল্পটি ভারত ও বাংলাদেশ কীভাবে তাদের কৌশলগত জোটকে শক্তিশালী করছে এবং এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে তাদের সংকল্পের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।

উপরন্তু, পাইপলাইন প্রকল্পটি একক ঘটনা হওয়ার পরিবর্তে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা এবং সহযোগিতার বৃহত্তর প্রবণতার একটি অংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও জ্বালানির মতো বিষয়ে দুই দেশ একাধিক চুক্তি করেছে। এটি উভয় পক্ষের মধ্যে একটি উন্নয়নশীল বোঝাপড়া প্রদর্শন করে যে একসাথে কাজ করা এবং সহযোগিতা করা তাদের সম্পর্কের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে সক্ষম করবে।

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ডিজেল পাইপলাইন দুই দেশের অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংযোগ জোরদারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার ক্ষমতা রাখে এবং এটি তাদের ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস ও সহযোগিতার স্পষ্ট লক্ষণ।

 

লেখিকা: মেহজাবিন বানু, কলামিস্ট, উন্নয়ন ও স্থানীয় সমাজকর্মী।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net