১৮ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার বাংলাদেশী সমকক্ষ শেখ হাসিনা আন্তঃসীমান্ত তেল পাইপলাইন উদ্বোধন করার পর ভারত এই মাসে একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ডিজেল রপ্তানি শুরু করবে।
“সুসংবাদ হল ভারত আমাদের ডিজেল পাঠাবে, (তেল) পাইপলাইন সম্পন্ন হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী ১৮ মার্চ পাইপলাইনের উদ্বোধন করবেন, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন।
ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইন কার্যত উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন
বাংলাদেশ এতদিন ভারত থেকে রেলের বগি দিয়ে ডিজেল আমদানি করত। মোমেনের ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব পাইপলাইন (আইবিএফপিএল) চালুর ঘোষণা এসেছে গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের ফাঁকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনার এক সপ্তাহ পরে।
১৩০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশে ডিজেল রপ্তানি করবে।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
ভারত-বাংলাদেশ তেল পাইপলাইনটি ৩.৪৬ বিলিয়ন রুপি ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এবং এটি ইন্ডিয়ান লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) থেকে টানা হয়েছে।
পাইপলাইনটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১২৫ কিলোমিটার এবং ভারতের অভ্যন্তরে ৫ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল।
আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে আসাম ভিত্তিক নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) মার্কেটিং টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পার্বতীপুর ডিপোতে জ্বালানি বহন করবে।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রকল্পের যান্ত্রিক কাজ শেষ হয়। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং প্রধানমন্ত্রী হাসিনার উপস্থিতিতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আইবিএফপিএল এর গ্রাউন্ড ব্রেকিং অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
২০১৭ সালে হাসিনার সাথে তার বৈঠকের সময়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বার্ষিক এক মিলিয়ন মেট্রিক টন (এমএমটিপিএ) ধারণক্ষমতা সহ আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইনের অর্থায়নে সম্মত হন।
প্রকল্পটি একবার সম্পন্ন হলে সেই সমস্যার সমাধান হবে যে ১,০০,০০০ টন ট্যাঙ্কার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে ডক করতে পারে না এবং অপরিশোধিত তেল পরিবহনের জন্য সামুদ্রিক জাহাজের উপর নির্ভর করতে হবে।
ভারতের সঙ্গে পাইপলাইনটি বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের পরিবহন খরচ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। শুক্রবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
“এটি [পাইপলাইন] একটি সাশ্রয়ী উপায়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে দ্রুত এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ প্রদানের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হবে।”
শুক্রবার দিনাজপুরের পার্বতীপুরে রসিদ টার্মিনাল পরিদর্শনকালে নসরুল ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনকে বাংলাদেশের জ্বালানি ইতিহাসে যুগান্তকারী হিসেবে বর্ণনা করেন। “এটি শক্তি নিরাপত্তা এবং কম খরচে জ্বালানি নিশ্চিত করবে।”
অদূর ভবিষ্যতে, বাংলাদেশকে তার জ্বালানি নিরাপত্তা এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসইতা নিশ্চিত করতে প্রচলিত শক্তির উৎস থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। ইউক্রেন সংকটের পর, জ্বালানি নিরাপত্তা উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলির জন্য একটি প্রধান উদ্বেগ হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে, আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি সহযোগিতা এবং বিদ্যুৎ করিডোরের ধারণা পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভবত বাংলাদেশকে তার জ্বালানি সংকট প্রশমনে সাহায্য করতে পারে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও উষ্ণ সম্পর্ক। যেকোনো সংকটকালে ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের পাশে মায়ের মতোই পাশে থেকেছে। তা বর্তমান করোনা মহামারীই হোক, কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। যাইহোক, মহামারী পরবর্তী যুদ্ধকালীন বৈশ্বিক সংকটের কারণে গোটা বিশ্ব বর্তমানে অস্থির। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি জ্বালানি সংকটও তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশও এই সংকটের কবলে পড়েছে। এই বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট নিরসনে বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি খরচ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই খরচ কমাতে বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়ে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ের মতো দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হলেও বাংলাদেশের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতই প্রথম জ্বালানি সরবরাহে এগিয়ে আসে।
বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতার বহুমাত্রিক পথের সূচনা শুধুমাত্র ভারতের সাথে ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণেই সম্ভব। এর একটি প্রধান উদাহরণ ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানি। এসব আমদানি ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে। চলতি বছরের জুনে ভারত থেকে পাইপলাইনে আসবে ডিজেল। এই ডিজেল আসতে শুরু করলে তা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে। এই ডিজেল বাণিজ্যে উভয় দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং বাংলাদেশ তার জ্বালানি সংকট আরও দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করতে পারবে। ভারতও এর সুফল পাবে। এই ডিজেল রপ্তানির মাধ্যমে ভারত রাজস্ব পাবে। ভারত ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে।
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে।
বাংলাদেশ-ভারত ডিজেল বাণিজ্য
২০১৭ সাল থেকে ভারত-বাংলাদেশ ডিজেল বাণিজ্য রেলের মাধ্যমে চলছে। প্রতি মাসে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে প্রায় ২,২০০ টন ডিজেল পাঠানো হয়। এই পরিবহন খরচ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানির জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। এই পাইপলাইনটি চালু হলে দেশে জ্বালানি সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে এবং রেলপথে জ্বালানি পরিবহনের খরচ কমবে। আমন ও বোরো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ডিজেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে এই জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬টি জেলায় ডিজেল গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে তা কৃষকদের দিতে সক্ষম হবে। ভারতের এই রপ্তানি শুধু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কই মজবুত করবে না, জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ডলার সংকটের সময় বন্ধুত্বের বন্ধনও মজবুত করবে। নিরবচ্ছিন্ন, সস্তা এবং দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি, আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইনটি রেল পরিবহনের কারণে ক্ষুদ্র চুরির মাধ্যমে সিস্টেমের ক্ষতি কমাতেও সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ পার্টনারশিপ পাইপলাইন চুক্তি
ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব পাইপলাইন চুক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নভেম্বর ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। যার মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত; কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে কাজের গতি কমে যাওয়ায় প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এখন এই বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১৩১.৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন প্রকল্পটি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এবং পার্বতীপুর, দিনাজপুরকে সংযুক্ত করে। পাইপলাইনের মোট দৈর্ঘ্যের মধ্যে ১২৬.৫০ কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং বাকি ৫.০৭ কিলোমিটার ভারতে। ৫২০ কোটি টাকার নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে ভারত সরকার ৩০৩ কোটি টাকা এবং বিপিসি বাকি ২১৭ কোটি টাকা দিচ্ছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করা যায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে আড়াই লাখ টন আমদানি করা হবে। ১৫ বছরের চুক্তি অনুযায়ী, আমদানির পরিমাণ বাড়বে বছরে ৪ থেকে ৫ মেট্রিক টন।
সংকটকালে আশার আলো?
সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশ যখন জ্বালানি সংকটে বিপর্যস্ত, তখন এই ডিজেল ব্যবসা এক ধরনের আশার আলো দেখাচ্ছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য ডিজেল আমদানির বিকল্প উৎস তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে ৬.৫ মিলিয়ন টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এই আমদানিকৃত জ্বালানির মধ্যে বছরে ৪ মিলিয়ন টন ডিজেল আমদানি করা হয়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পরিবহন খরচ কমিয়ে আমদানি করা জ্বালানির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ এ দেশে আসবে।
অধিকন্তু, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) জ্বালানি তেলের (মালবাহী বাহন সহ) গড় প্রিমিয়াম খরচ $১০। এই জ্বালানি ভারত থেকে আমদানি করলে খরচ হয় আট ডলার। ব্যারেল প্রতি দুই ডলারের হ্রাস প্রতি ১০,০০০ টনে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। জ্বালানি সরবরাহে কম সময় লাগা ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ এ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তাই ভারত থেকে আমদানি করলে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। এখন ডলারের পরিবর্তে রুপিতে আমদানি করা সম্ভব হলে আমাদের ডলার সংকট কিছুটা হলেও কমবে। পরে ভারত বাংলাদেশকে দামে কিছুটা ছাড় দিলে বাংলাদেশ আরও লাভবান হতে পারে।
অন্যদিকে রপ্তানিকারক ভারত তার রপ্তানি আয় থেকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ অর্জন করতে পারে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। ভারত কম দামে বাংলাদেশে পরিশোধিত তেল রপ্তানি করলেও তা উভয় দেশের জন্যই সামগ্রিক অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে। ভারত ও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক শক্তি সহযোগিতার মাধ্যমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ জ্বালানি মূল্যের বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে। যখন ডিজেল আসতে শুরু করে, ভারত-বাংলাদেশ জোট পাইপলাইন, যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে দ্বিপাক্ষিক শক্তি সহযোগিতার একটি প্রধান উদাহরণ হতে পারে। শুধু তাই নয়, এটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার সূচনা করবে।
লেখিকা: জুবেদা চৌধুরী, শিক্ষিকা এবং ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net