ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সংলাপ ও নিরাপত্তা সম্পর্ক নিয়ে কিছু ভাবনা

:: কামাল উদ্দিন মজুমদার ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত ও বাংলাদেশ পারষ্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থনের মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। এর পর থেকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সক্রিয় সম্পৃক্ততার অংশ হিসেবে সার্ভিস চিফ পর্যায়ে উচ্চ পর্যায়ের বিনিময়, প্রতিরক্ষা সচিবদের দ্বারা বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ পরিচালনা, ত্রি-বাহিনী এবং পরিষেবা-সংশ্লিষ্ট স্টাফ আলোচনা চলমান রয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ইন্টারেক্টিভ প্রক্রিয়া। এই সংলাপের মধ্যে, উভয় দেশ তাদের নিজ নিজ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দেয়। ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকায় ভারত ও বাংলাদেশের পঞ্চম বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব গিরিধর আরামানে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ২৮ আগস্ট প্রতিরক্ষা সচিব গিরিধর আরামানে দু’দিনের বাংলাদেশ সফর করেন।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চলমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার উদ্যোগগুলির একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা করেন। উভয় পক্ষই প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান স্তরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গিরিধর এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সংলাপের ফলপ্রসূ প্রকৃতির কথা উল্লেখ করেন এবং পঞ্চম বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপে প্রতিষ্ঠিত অভিন্ন ঐকমত্যের ভিত্তিতে চলমান সম্পৃক্ততার সম্ভাবনার উপর জোর দেন। উভয় দেশের সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা ভবিষ্যতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক দৃষ্টিভঙ্গি নির্দেশ করে।

ক্রমবর্ধমান কৌশলগত সম্পর্ক

বিগত কয়েক বছরে নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ সৌহার্দ্য নিঃসন্দেহে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং এটি সহজেই অনুমান করা যেতে পারে যে ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে “আরও গভীরতা এবং গতি” পাবে কারণ উভয় দেশ একে অপরের উদ্বেগগুলি মোকাবেলা করতে এবং অভিন্ন সমাধানের জন্য কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

২০১৭ সালের এপ্রিলে শেখ হাসিনার চার দিনের নয়াদিল্লি সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের এটিই প্রথম এ ধরনের চুক্তি। এসব চুক্তির আওতায় দুই দেশের সামরিক বাহিনী যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করবে। বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা ম্যানুফ্যাকচারিং ও সার্ভিস সেন্টার স্থাপনে সহায়তা করবে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করবে। ভারত থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশকে প্রথমবারের মতো প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত লাইন অফ ক্রেডিট প্রস্তাব করেছে ভারত।

যৌথ প্রশিক্ষণ ও মহড়ার আওতায় দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী এখন যৌথ মহড়া, চিকিৎসা সহায়তা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। ২০২২ সালের ১৬ জুন যশোর মিলিটারি স্টেশনে সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ সামরিক মহড়া ‘সম্প্রীতি’র দশম সংস্করণ সম্পন্ন হয়। এই মহড়ায় উভয় সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্টরা একে অপরের কৌশলগত মহড়া এবং অপারেশনাল কৌশলগুলি বিনিময় করে এবং জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের অধীনে বিদ্রোহ দমন, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী, শান্তিরক্ষা এবং দুর্যোগ ত্রাণ কার্যক্রমে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।

নিরাপত্তা সহযোগিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ভারতের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট  পলিসি’র অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে একটি উষ্ণ সম্পর্ক এবং সহযোগিতা ভাগ করে নিয়েছে। এখন তাদের সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত পারস্পরিক সফর রয়েছে।

স্পষ্টতই, বাংলাদেশ উত্তর-পূর্বদিকে ভারতের স্থল সংযোগের সাথে যুক্ত। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা দিল্লিকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, সন্ত্রাস বাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো চরমপন্থি কার্যকলাপের জন্য ‘তার এক ইঞ্চি ভূখণ্ডও’ ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সেভেন সিস্টার্স-এ নয়াদিল্লির প্রধান “নিরাপত্তা উদ্বেগ” ইতিমধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে মোকাবেলা করেছে।

উভয় দেশ ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা, সামুদ্রিক বিষয়, জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, যৌথ মহড়া এবং মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণ (এইচএডিআর) খাতে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করছে। সর্বশেষ ৫ম বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার তাৎপর্যতুলে ধরে, যা “প্রতিবেশী প্রথম” নীতির প্রতীক।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান ২০২৩ সালের এপ্রিলে ভারত সফর করেন এবং চেন্নাইয়ের অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে পাসিং আউট কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। যৌথ সামরিক মহড়ার মতো দ্বিপাক্ষিক ইভেন্ট এবং সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের ঘন ঘন সফর উভয় দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। যৌথ প্রশিক্ষণ ও মহড়া এবং প্রতিরক্ষা আলোচনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী আরও বেশি করে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই সামুদ্রিক নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব জোরদার করার জন্য ঘনিষ্ঠ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে উপকূলীয় নজরদারি রাডার সিস্টেম স্থাপনসংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ আইএনএস ‘কুলিশ’ এবং আইএনএস ‘সুমেধা’ ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের মংলা বন্দরে ডক করেছিল।

মার্কিন ফ্যাক্টর

দু:খজনক বিষয় হলো, চীনের সম্প্রসারণবাদী চক্রান্ত ঠেকাতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে ভারতের (দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি) সঙ্গে আলোচনা না করেই নিষেধাজ্ঞাসহ বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসন ভালো করেই জানে যে, বাংলাদেশকে চাপ দেওয়া মানে চীনের দিকে ঠেলে দেওয়া। মিয়ানমারের ওপর মার্কিন ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাবও একই রকম। পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং নেপাল ইতিমধ্যে চীনের ঋণের ফাঁদে পড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের উপর আমেরিকার অব্যাহত চাপের অর্থ হল ভারতকে চারদিক থেকে চীনের প্রভাব বলয়ে রাখা। সেক্ষেত্রে  ভারতকে নিজেকে বাঁচাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি আনুষ্ঠানিক জোট খোঁজা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই যেমন ইউক্রেন মার্কিন-ন্যাটো প্রক্সি হিসাবে রাশিয়ার সাথে লড়াই করছে।

হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, “আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক হতে পারে, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া মারাত্মক। কিসিঞ্জারের অনেক আগে ১৯৪০ সালে সিনেটর হিসেবে হ্যারি ট্রুম্যান বলেছিলেন, ‘আমরা যদি দেখি জার্মানি জিতছে, তাহলে আমাদের উচিত রাশিয়াকে সাহায্য করা এবং রাশিয়া জিতলে আমাদের উচিত জার্মানিকে সাহায্য করা। আমেরিকান নীতি হচ্ছে দেশগুলোকে ব্যবহার করা এবং ছুঁড়ে ফেলা, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকা উচিত ভারতের স্বার্থে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই সার্ক, বিমসটেক এবং আইওআরএর সদস্য। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর এবং ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পারস্পরিক ভারত সফরের পর থেকে যে সব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে ছিটমহল ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা স্থল ও সমুদ্রসীমার সমাধান, ইলেকট্রনিক্সের মতো হাই-টেক ক্ষেত্র নিয়ে ৯০টিরও বেশি চুক্তি সম্পাদন, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ, তথ্য প্রযুক্তি এবং বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি, পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও সত্যিকারের কৌশলগত বন্ধু। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৫ম বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত সংলাপ সমসাময়িক সম্পর্কের গতিশীলতা সুসংহত করতে এবং অভিন্ন ভৌগোলিক, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ভিত্তিতে বন্ধন পুনরুজ্জীবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 

লেখক: কামাল উদ্দিন মজুমদার; গবেষক, অনুবাদক ও কলামিস্ট।