নতুন ভাইরাসে কাঁপছে দেশ। হয়তো খুব শিগগির মহামারি হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গবেষকরা প্রতিষেধক হিসেবে এখনো কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার করতে পারেন নাই। তবে সুখের বিষয় এ ভাইরাস ছোঁয়াচে নয়, যা শুধু মানুষের মনে আক্রমন করে। আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ভয় না থাকলেও মনে চিরকাল ক্ষত থেকে যায়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। তবে আশা করা যায়, খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলবেন বিজ্ঞ গবেষকরা।
কোভিড ১৯ ভাইরাস আমাদেরকে ঘরবন্দি করে ফেলেছিল। যা অল্প সময়ে মহামারি হিসেবে বিশ্বের সবদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। মৃত্যু ভয়ে মানুষ সারাক্ষণ কাঁপছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরিবারের মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের করে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে। উন্নত দেশের গবেষকরা দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রতিষেধক হিসেবে টিকা আবিষ্কার করে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
অনেকে হয়তো ভাবছেন দেশে নতুন এমন কি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হলো। করোনাভাইরাসের নাম শোনেছি। নতুন কোনো ভাইরাসের নাম তো শুনি নাই। যাই হোক আর ধোয়াসায় না রেখে এবার খোলাসা করি। ইহা ঔপনিবেশিক আমলের খুব-ই পুরাতন ভাইরাস নতুন করে ভাইরাল হয়েছে SIR ভাইরাস।
সম্প্রতি রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক ও রংপুরের জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মধ্যে চলমান স্যার বিতর্ক দেশবাসীকে চরমভাবে হতাশ করছে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাউকেই স্যার ডাকার কোনো বাধ্যবাধকতা সংবিধানে নাই। বরং রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে জনগণ সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এমনকি জনগণ তাদের স্যার ডাকার দাবি করলেও অযৌক্তিক হবে না। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং জেলা প্রশাসক দুজনই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সুতরাং কারোই স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার আইনগত কোনো ভিত্তি নাই।
এধরণের ঘটনার অভিযোগ আমাদের দেশে এটাই প্রথম তা কিন্তু নয়। এর আগেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি কর্মকর্তাকে স্যার সম্বোধন না করায় সাধারণ জনগণের ওপর চটে গিয়ে অশোভন আচরণ করেছেন অনেক কর্মকর্তা। এ নিয়ে পত্রিকায় বহুবার সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। উদারহরণ হিসেবে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। যেমন- মানিকগঞ্জে ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে আপা বলায় ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে তার সাথে থাকা পুলিশ৷ মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাস এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা তাকে ভাই বলায় বিরক্ত হন৷ নেত্রকোনার কালমাকান্দা উপজেলায় ইউএনওকে স্যার না বলায় থানার ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে হেনস্তা করেন৷ গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামুন খানকে সাংবাদিক আশিক জামান ফোনে তথ্য নিতে গিয়ে ভাই বলায় তিনি ক্ষেপে যান৷ কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লুৎফুল আজাদ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার মুহাম্মদ মুশফিকুর রহমানকে ভাই বলায় শিক্ষকের ওপর ক্ষেপে যান। গুটি কয়েক সরকারি কর্মচারীর এধরণের ঔপনিবেশিক মানসিকতায় সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হয়।
দেশব্যাপী যখন স্যার শব্দটি নিয়ে ঝড় বইছে উল্টো দিকে বরিশালের সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজের সেবাগ্রহীতাদের সাথে স্যার সম্বোধন বাহবা কুড়িয়েছে।
চট্টগ্রামের রাউজান-রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন শামীমের অফিসে রিক্সাচালক মোতালেব মিয়া আইনগত সেবা নিতে অফিসারের কক্ষে ঢুকতেই ‘স্যার প্লিজ বসুন, আপনাকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি?’ এএসপির সুন্দর ব্যবহার আর সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলার প্রশংসা সকলের মুখে। রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে সকল ছোট বড় পেশার মানুষকেই তিনি স্যার বলে সম্বোধন করেন। এতে এএসপি ছোট হননি বরং প্রশংসিত হয়েছেন।
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ কুদ্দুস তার কার্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে লেখা ‘আমার নির্বাচনী এলাকার সকল জনগণকে বিনীত অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করবেন না। আমি আপনাদের ভাই, বন্ধু, সেবক এবং সেবক হয়েই থাকতে চাই।’
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে প্রজাতন্ত্রের ‘সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং ২১ (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’৷
সংবিধান মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্তরা সাধারণ জনগণের সেবক। যেহেতু সরকারি চাকরিজীবীরা জনগণের সেবক সেহেতু জনগণই বরং স্যার ডাক প্রাপ্য। আর জনগণ তাদের সেবকদের স্যার, না ভাই, না আপা কী বলে সম্বোধন করবে সেটা একান্তই জনগণের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনো কর্মকর্তাকে স্যার সম্বোধন না করলে তিনি যদি রেগে যান, দুর্ব্যবহার করেন, তবে সেটা একান্তই তার মূর্খতা এবং বোকামির বহিঃপ্রকাশ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এক বক্তৃতায় বলেছেন-“আমি সরকারি কর্মচারীদের বলবো, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। ব্রিটিশ কলোনি নয়। পাকিস্তান কলোনি নয়। সাধারণ মানুষের মুখের দিকে একটু ভালোভাবে চেয়ে দেখো; তার চেহারাটা তোমার বাবার মত কিংবা তোমার ভাইয়ের মতো। তারাই এদেশে বেশি সম্মান পাবে। কারণ এরা নিজের টাকায় খায়। নিজের টাকায় চলে। আর তোমরা ওদের টাকায় বেতন নাও।’ আপনি চাকরি করেন আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই প্রকৃত মালিক। ওদের টাকায়ই আপনাদের সংসার চলে।’….
স্যার বলা বা বলতে বাধ্য করানো ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’৷ সম্মানের বিষয়টি পারস্পরিক তা জোর করে আদায় করা যায় না৷ সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মচারীদের কীভাবে সম্বোধন করবেন সেই বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারের নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন৷ যেহেতু এটা নিয়ে বার বার কথা হচ্ছে তাই সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সম্বোধন কী হবে৷ এটা নাম, পদ বা অন্য কোনোভাবে সম্বোধন হতে পরে৷ তবে অবশ্যই স্যার না।
দেশের অধিকাংশ জনগণ সচেতন না বিধায়, তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানেও না, বোঝেও না। ফলে অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অসচেতন জনসাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার সাহস পায় ও সুযোগ নেয়।
তবে জনগণকেও মনে রাখতে হবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিরা আমাদের দেশেরই সন্তান, আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন, আমাদেরই আত্মীয়। তারা জনগণের সেবায় নিয়োজিত। তারাও সম্মাননীয়। উনারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় এবং সার্বক্ষণিক সেবায় দিনরাত পরিশ্রম করেন। তাদেরকেও সম্মান করতে হবে।
লেখক: মো. নবী আলম, উন্নয়ন কর্মী ও সাংবাদিক।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net