বেনজীর আহমেদের বাঁচার উপায় কী

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৫ মাস আগে
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ

আদালতের শরণাপন্ন না হয়ে আর কোনও উপায় নেই সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের। কারণ, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং অস্থাবর সম্পদ তথা বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়ার পরপরই তা কার্যকর হয়ে যায়।

এ আদেশের পর তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা কোনও স্থাবর সম্পদ হস্তান্তর করতে পারবেন না সাবেক এই আইজিপি। অপরদিকে আদালতের পুনরায় নির্দেশ ছাড়া কোনও ব্যাংক হিসাবেই তিনি আর লেনদেন করতে পারছেন না। যে কারণে তাকে আদালতে যেতেই হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ বা ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছেন। এ আদেশের পর তিনি আবারও আলোচনায় আসেন।

আজ রোববার (২৬ মে) পরিবারসহ বেনজীর আহমেদের আরও ১১৯ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৩ মে বেনজীর আহমেদের সব ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) এবং গোপালগঞ্জ ও কক্সবাজারের তার ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়। এরপর আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়ায় তা ক্রোকের আবেদন করে দুদক। আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এর আগে গত ২২ এপ্রিল বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্তের বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন ওইদিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুদকের উপ-পরিচালক হাফিজুল ইসলামকে প্রধান করে সহকারী পরিচালক নিয়ামুল হাসান গাজী ও জয়নাল আবেদীনের সমন্বয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. হাফিজুল ইসলাম ও পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আদালতে বেনজীর আহমেদের স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করার আবেদন জানান। শুনানি শেষে আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করে ৮২টি দলিলে থাকা স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন। এর আগেই দুদক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আটটি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়।

আদালতের আদেশে গোপালগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি), টুঙ্গিপাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি), কোটালীপাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি), টেকনাফের সহকারী কমিশনার (ভূমি), উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি), গোপালগঞ্জ সদরের সাব-রেজিস্ট্রার, টুঙ্গিপাড়ার সাব-রেজিস্ট্রার, কোটালীপাড়ার সাব-রেজিস্ট্রার, টেকনাফের সাব-রেজিস্ট্রার এবং উখিয়ার সাব-রেজিস্ট্রারকে এ আদেশ বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে। আদেশে বলা হয়— তফসিলে বর্ণিত স্থাবর সম্পদের ওপর ক্রোকাদেশ (অ্যাটাচমেন্ট) আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় কোনও অবস্থাতেই তা হস্তান্তর বা বিনিময় করা যাবে না।

এছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বর্ণিত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদেরও আদেশ দেন আদালত। ওই আদেশে বলা হয়, উল্লিখিত হিসাবগুলোর ওপর অবরুদ্ধকরণ (ফ্রিজিং) আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় অর্থ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) হিসাবগুলোতে অর্থ জমা করা যাবে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই সেটা উত্তোলন করা যাবে না।

সিটি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, আইএফআইসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড, ড্রাগন সিকিউরিটিজ লিমিটেড, সাউথ ইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিস লিমিটেড, ইস্টার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেড এবং ডাইনেস্টি সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিসান মির্জা, মেয়ে তাসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে ছাড়াও তাদের বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব (অ্যাকাউন্ট) রয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনকে দেওয়া আদালতের আদেশে বলা হয়, ‘এই আদেশটি দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা অনুসারে দুর্নীতি দমন কমিশনের ব্যয়ে বিজ্ঞপ্তি আকারে বহুল প্রচারিত একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রচারের নির্দেশ দেওয়া গেলো।’ একইসঙ্গে আদালতের আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাঠানোর জন্যেও নির্দেশ দেন আদালত।

এ বিষয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের কোনও স্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়নি। ক্রোক বা (অ্যাটাচড) করা হয়েছে। আর অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ বা ফ্রিজ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকালে আদালতের আদেশের পরই এটা কার্যকর বলে গণ্য হবে। কেউ এর ব্যত্যয় করলে তিনিও আদালতের আদেশ অমান্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।’

আদালতের আদেশের পর থেকে সাবেক দাপুটে আইজিপি বেনজীর আহমেদ একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। গত দুদিনে তিনি কোনও গণমাধ্যমের সঙ্গেই কথা বলছেন না। যদিও এর আগে গত ২০ এপ্রিল তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক ভিডিও বক্তব্যে কিছু কথা বলেছিলেন। তখন তিনি তার অর্জিত সম্পদ নিয়ে বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ দিতে পারলে প্রমাণদাতাকে সেই সম্পদ বিনামূল্যে দিয়ে দেবেন।

এ বিষয়ে বেনজীর আহমেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তার স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধের পর তিনি কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, জানতে চাইলে তার আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, তারা এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি বলেন, কবে নাগাদ উচ্চ আদালতে যাবেন সেটা দুই-একদিনের মধ্যে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন।

প্রসঙ্গত, গত ৩১ মার্চ একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়— সাবেক মহাপরিদর্শক তার স্ত্রী জিশান মির্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে বেনজীর আহমেদের দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার পাশে বিঘার পর বিঘা জমি রয়েছে। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার। পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় আছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরও ১০ বিঘা জমি। অথচ গত ৩৪ বছর ৭ মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট আয় ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকার মতো হওয়ার কথা।

এরপর গত ২২ এপ্রিল পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। দুদক চেয়ারম্যান, সচিবসহ চার জনকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাউদ্দিন রিগ্যান এই রিট দায়ের করেন।

সৌজন্যে: বাংলা ট্রিবিউন।