আগামী ৫-৬ ডিসেম্বর ঘানায় ২০২৩ সালের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক (ইউএনপিকেএম)অনুষ্ঠিত হবে।এই বৈঠকের আগে প্রস্তুতিমূলক আলোচনায় অংশ নিতে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ডিপার্টমেন্ট অব পিস অপারেশনস (ইউএসজি ডিপিও), জেনারেল জিন পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স ২৫ থেকে ২৬ জুন বাংলাদেশ সফর করবে। এই সফর একটি নিয়মিত ও পূর্বনির্ধারিত সফর। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক বিশ্বে চলমান শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের কার্যকারিতা এবং তারা যেসব দেশে কাজ করে সেই দেশগুলোতে প্রভাব বাড়াতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। চলমান শান্তিরক্ষা মিশনগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তাই সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা, কৌশলগত যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও শান্তিরক্ষী নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। বাংলাদেশ, কানাডা ও উরুগুয়ে এই তিনটি দেশ এবার ঢাকায় এই প্রস্তুতিমূলক সম্মেলনের আয়োজন করছে।
১৯৮৮ সালে ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে ১৫ জন চৌকশ সেনা পর্যবেক্ষক পাঠানোর মধ্যদিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে অদ্যবধি বাংলাদেশ বিশ্বের নানা প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলছে।স্থানীয় জনগণের আস্থা আর ভালোবাসা জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মূলশক্তি। শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ও সামরিক দক্ষতার জন্য জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও সামরিক কমান্ডারদের কাছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের গ্রহণযোগ্যতা সর্ববিদিত। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিগত ৩৫ বছর ধরে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পেশাগত দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুউন্নত করেছে এবং আমাদের শান্তিরক্ষীদের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য প্রেরণে ১১৮টি দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। এক লাখ ৮১ হাজার ৬৬১ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী জাতিসংঘের ৫৬টি শান্তিরক্ষা মিশনে সফলভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে যা একটা দেশের জন্য দুর্লভ অর্জন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তাদের দায়িত্ব পালনকালে ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মোট ১৩৯ জন জীবন বিসর্জন দিয়েছেন এবং ২৪২ জন আহত হয়েছে। তাদের এই আত্মতাগ বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শান্তিরক্ষী দেশ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিসংঘের চলমান শান্তিরক্ষা মিশনে সর্ববৃহৎ কন্টিনজেন্ট পাঠানোর পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তি কার্যক্রমের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায়ও নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বাংলাদেশকে জাতিসংঘের একটি মডেল সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং শান্তিরক্ষা ও মানবিক কার্যক্রমে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করে। বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী নির্বাচনে তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা, মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এবং সাহস বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের মান নিশ্চিত করে। বিশ্বের বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা সম্পর্কে জাতিসংঘ অবগত এবং দেশগুলির স্থানীয় জনগণ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদেরকে তাদের দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য নিবেদিত বলে মনে করে।
জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ল্যাক্রোইক্সের এই সফর বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে এবং শান্তিরক্ষায় দায়িত্বপালন সংক্রান্ত কার্যক্রমে এই সফর ও প্রস্তুতিমূলক আলোচনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা হচ্ছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী প্রধান বাংলাদেশ থেকে শান্তিরক্ষীর নেয়ার নতুন সম্ভাবনার সূচনা করবে ও বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাবে। শান্তিরক্ষায় ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ও হুমকির কারণে কিছু সদস্য রাষ্ট্র তাদের শান্তিরক্ষী প্রত্যাহার করলে তা পূরণ করতে বাংলাদেশ থেকে শান্তিরক্ষী নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হবে। এই সফর বাংলাদেশের অব্যাহত কূটনৈতিক সাফল্যের অংশ এবং একে ভুলভাবে বোঝার বা এসংক্রান্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো কারন নেই। এটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কূটনীতিতে বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতিফলন এবং আসন্ন সফরের জন্য আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত। জাতিসংঘের এই শীর্ষ কর্মকর্তার সফর প্রমাণ করে যে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ভেতরের ও বাইরের কিছু গোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য দেওয়ার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অতীতের বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সুনাম, কৃতিত্ব অর্জন এবং মানবাধিকার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অর্জন ও ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা ইতিবাচক ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য জাতিসংঘের ভেতরে বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব তৈরি করার প্রবনতা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার কখনও সফল হয়নি এবং এই অপপ্রচার মোকাবিলায় মিডিয়ার কার্যকর অবদান রাখাও জরুরি।বর্তমানে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত কালচার অব পিস বা শান্তির সংস্কৃতির প্রস্তাব ১০০টি রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে পাস হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান জাতিসংঘের কাছে স্পষ্ট এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘে বিভ্রান্তি তৈরির কোনো অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের কর্মদক্ষতা ও আন্তরিকটা দিয়ে সবার কাছ থেকে সুনাম ও ভালোবাসা অর্জনে মধ্য দিয়ে তাদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।বাংলাদেশের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন যে, মানবাধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সেনাদের ভূমিকা তাঁকে মুগ্ধ করেছে, এটা শান্তিরক্ষীদের সাফল্যেরই স্বীকৃতি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান রাখা দেশগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব পিসকিপিং অপারেশন্সের প্রতিবেদন অনুসারে, সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বের ৪০টি দেশের ৫৪টি মিশনে শান্তি রক্ষায় অসামান্য অবদান রেখে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা বিশ্বব্যাপী দেশের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও তারা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। শান্তিরক্ষী ও বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বর্তমানে দেশের রেমিটেন্স আয় হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশী। সংঘাতময় পরিস্থিতি ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শান্তির বার্তা বিশ্বমানবতার সেবায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এই মহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পরিচিতি ও সম্মান বাড়ছে। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল শান্তির সুবাতাস বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ুক এটাই সবার প্রত্যাশা হওয়া দরকার।
বর্তমান শতাব্দীতে তৃতীয় প্রজন্মের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বহুমাত্রিক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এজন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনী পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে চলেছে। ভয়-ভীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা শান্তির বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো একটি প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনী বিশ্বের যেকোনো স্থানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে সফলতার সাথে বৈশ্বিক শান্তিরক্ষায় তাদের অবদানের কারনে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে এবং শান্তিরক্ষী সদস্যরা বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এই প্রক্রিয়া চলমান রাখতে সচেষ্ট। বর্তমানে জাতিসংঘের ৯টি দেশের ১০টি মিশনে ৬ হাজার ৯ জন সেনাসদস্য কর্মরত রয়েছে। তাদের অনন্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের পাশাপাশি শান্তিরক্ষা মিশনে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সফলতার কথা সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো তুলে ধরলে দেশের সম্মান বাড়ে। দল মত নির্বিশেষে এই সম্মান বাংলাদেশের সব মানুষের। বহু দশক ধরে তিল তিল করে আত্মত্যাগের মাধ্যমে গড়ে উঠা সুনামের অংশীদার সারা বাংলাদেশ। এই সুনামের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বুকে শান্তির নিশানা হিসেবে আমাদের লাল সবুজ পতাকা সমুন্নত থাকুক এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল। মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।