বিয়ে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। চারিত্রিক পবিত্রতা ও নির্মলতা অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। হালাল সম্পর্ক ও পবিত্র বংশধারা টিকিয়ে রাখতে বিয়ের বিকল্প নেই। এটি আল্লাহর বিধান। সুন্নতে নববি। মূলত সৃষ্টিগতভাবেই নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারী ছাড়া পুরুষ এবং পুরুষ ছাড়া নারীর জীবন অসম্পূর্ণ। বিয়ের মাধ্যমে মানুষের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব দূর হয়।
জীবনে সুখ-শান্তি ও আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায়। শরিয়তসম্মত উপায়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে যেমন অসংখ্য গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়, তেমনি খুব সহজেই রাসুল (সা.)-এর একটি সুন্নতও আদায় হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর হজরত হাওয়া (আ.)-কে তার জীবনসঙ্গীরূপে সৃষ্টি করেন। তাদেরকে ভালোবাসার বন্ধনে গেঁথে দেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনো পৃথিবীতে চলমান।
পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘আর তার (আল্লাহ) নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও মায়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম : ২১)
কখন বিয়ে করবেন?
এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর যার বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা রাখে। কেননা, রোজা তার যৌনতাকে দমনকারী।’ (বুখারি : ৫০৬৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলো, সে যেন তার অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করল।’ (মেশকাত : ২৯৬২)।
উপরোক্ত হাদিসে ‘যুবক সম্প্রদায়’ এর ব্যাখ্যায় ইমাম নববি রহ. লিখেছেন, “যুবক-যুবতী বলতে বোঝানো হয়েছে যারা বালেগ [পূর্ণ বয়স্ক] হয়েছে এবং ত্রিশ বছর বয়স পার হয়ে যায়নি।”
আর এ যুবক-যুবতীদের বিয়ের জন্য রাসুল (সা.) গুরুত্বারোপের কারণ সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রহ.) রচিত বুখারির বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ উমদাতুল ক্বারিতে লিখেছেন, ‘‘হাদিসে কেবল যুবক-যুবতীদের বিয়ে করতে বলার কারণ হল– বুড়োদের অপেক্ষায় এ বয়সের লোকেদের মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা ও দাবী অনেক বেশি থাকে।”
শরীয়তের দৃষ্টিতে বিয়ে না করলে যাদের ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার দৃঢ় আশঙ্কা হয়, তাদের জন্য বিয়ে করা ফরজ। আর প্রবল আশঙ্কা না হলে বিয়ে করা ওয়াজিব। বিয়ে না করলে গুনাহের আশঙ্কা না থাকলে বিয়ে করা সুন্নাত। তবে কেউ যদি স্ত্রীর ভরণপোষণে সক্ষম না হয়, কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়, তাহলে বিয়ে করা জায়েয হবে না।
বিবাহে বিলম্ব না করা উচিত
হাদিসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধীরস্থিরতা অবলম্বনের কথা বলা হলেও কিছু কিছু কাজ তাড়াতাড়ি করার কথা এসেছে। মহানবি (সা.) স্বীয় জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলি (রা.)-কে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে আলি! তিন কাজে দেরি করবে না। সময় হয়ে গেলে নামাজ আদায়ে, জানাযা এসে গেলে জানাযার নামাজ পড়তে এবং কুফু মিলে গেলে বিবাহে বিলম্ব করবে না।’ (তিরমিজি : ১৭১)
বর্তমানে যুবকদের অন্যতম সমস্যা– সময়মতো বিবাহ না করা। এটি একটি মারাত্মক সমস্যা, যার ফলে যুব সমাজ আজ ধ্বংসের মুখে। মূলত তারা বিভিন্ন ছুতোয় বিবাহে বিলম্ব করে, যেমন :
এক- বিবাহ করলে খরচ বেড়ে যাবে। আমি তো নিজেই চলতে পারি না; বউকে চালাবো কিভাবে!
দুই- চাকরি-বাকরি করে আগে স্ট্যাবলিশ হতে হবে তারপর বিবাহের প্রসঙ্গ।
তিন- বিবাহের জন্য আগে বিপুল ধনসম্পদ জমাতে হবে, তারপর মহাড়ম্বরে বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে।
চার- বিবাহ স্বাধীন লাইফ স্টাইলের পথে অন্তরায়, তাই বিলম্বিত বিবাহেই মুক্তি।
পাঁচ- আমি তো বেকার ছেলে! কিংবা আমার তো একটা ভালো জব নেই!
—ইত্যাদি আরো অনেক ছুতোর আশ্রয় নিয়ে বিবাহকে বিলম্বিত করা হয়। অথচ গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া ইসলামে বিলম্বিত বিবাহ নিষেধ। এক্ষেত্রে অভিভাবকের দায়িত্ব হল : ছেলে-মেয়ে বিবাহের বয়সে উপনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদেরকে বিবাহ দিয়ে দেওয়া। কারণ পরিণত বয়সে পদার্পণ করার পরও ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং মেয়ের পড়াশোনা শেষ করার অজুহাতে বিবাহে বিলম্ব করা অনুচিত। অন্যথায় বিবাহবহির্ভূত অবৈধ মেলামেশার কারণে তারা গুনাহগার হবে এবং যথাসময়ে বিবাহ না দেওয়ার অপরাধে তাদের এই গুনাহের একটি অংশ অভিভাবকদের উপরও বর্তাবে।
ইসলাম ছেলে-মেয়েকে সময়মতো বিবাহ দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহের ঘোষণা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন তাদের বিয়ে সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও । তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” (সুরা নুর : ৩২)
আফসোসের বিষয়, আল্লাহ তাআলা বিবাহের মাধ্যমে রিযিকে প্রশস্ততা বাড়িয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন– অথচ আমরা রিযিকের ভয়ে বিবাহ করতেই টালবাহানা করি!
মনে রাখতে হবে, রিযিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “আর জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল।” (সুরা হুদ : ৬)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে এবং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিয়ে করে– তাকে সাহায্য করা আল্লাহর জন্য কর্তব্য হয়ে পড়ে।’ (মেশকাত : ১৯৫৫)
সুতরাং আল্লাহ তাআলা যাকে বিবাহ করার তাওফিক দেন তার এবং তার স্ত্রী-সন্তানের রিযিকের ব্যবস্থা তিনিই করবেন।
সামাজিক কুসংস্কার ভেঙে বিবাহ করুন
আমাদের সমাজে বিয়ে নিয়ে প্রচলিত অনেক রেওয়াজ ও কুসংস্কার বিলম্বিত বিবাহের প্রধান দায়ী। এসব রেওয়াজ কিংবা সংস্কৃতির করণে বিবাহকে আমরা জটিল করে তুলেছি। যার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভালো চাকরি কিংবা উচ্চ ডিগ্রী অর্জনের সঙ্গে বিবাহের কোনো যোগসূত্র নেই। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত সমাজকে ভয় না করে আল্লাহকে ভয় করা। মূলত স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক কোনো ডিগ্রীর উপর নির্ভর করে না। সত্যিকারের সুখী দাম্পত্য জীবন তো তাদের, যারা একে অপরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসবে। স্ত্রীর কাছে স্বামীর পরিচয় ড. কিংবা ইঞ্জিনিয়ার নয়; বরং ইসলামে স্বামী-স্ত্রীকে একে অপরের পোশাক বলা হয়েছে। যেখানে ডিগ্রী কিংবা অর্থনৈতিক কোনো পার্থক্য নেই। রাসুল (সা.) বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, “তোমরা দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দাও। নয়তো তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (বুখারি : ৫০৯০)।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চরিত্রহীন বদস্বভাবের মানুষের সঙ্গে যেমন সংসার সুখের হয় না, তেমনি কেবল বিত্তশালী হলেই তার সঙ্গে সংসার সুখের হয় না। টাকা-পয়সা, অর্থকড়ি এবং বাহ্যিক সৌন্দর্য এই আছে, এই নেই; কিন্তু মানুষের দ্বীনদারি, সৎচরিত্র, সুন্দর আখলাক আমৃত্যু অমূল্য সম্পদ।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ যদি কোনও নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাহলে সর্বপ্রথম তার সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। যদি এ ব্যাপারে তার প্রশংসা করা হয়, তাহলে তার দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। দ্বীনের ক্ষেত্রে যদি প্রশংসিত হয়, তাহলে বিয়ে করবে; অন্যথায় দ্বীনের কারণে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু এমনটি করা ঠিক নয় যে— প্রথমেই দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, আর এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় হলে সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে; এরপর সৌন্দর্যের ব্যাপারে প্রশংসনীয় না হলে ফিরিয়ে দেবে। তাহলে এ প্রত্যাখ্যান হবে সৌন্দর্যের কারণে; দ্বীনের কারণে নয়।’ (শরহু মুনতাহাল ইরাদাত, লিল-ইমাম বুতি : ২/৬২১)
বর্তমানে বিবাহে অহেতুক খরচ করা এবং জমকালো আয়োজন করে বিবাহ সম্পন্ন করা যেন একধরণের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে! ঋণ করে কিংবা ভিক্ষা করে হলেও যেন অহেতুক খরচ বাড়িয়ে মহাসমারোহে বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে। যার ফলে আজ বিবাহের মতো সহজ কাজটি অনেকের জীবনে জটিল হয়ে গেছে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে যে বিয়েতে খরচ যত কম হয়, সে বিয়ে তত বরকতপূর্ণ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম বিয়ে হলো– যা খরচের দিক থেকে সহজসাধ্য হয়। ’ (আবু দাউদ : ২১৯)
সত্যি বলতে, সামাজিক মায়াজালে আটকে আমরা কতভাবে যে জীবনে হেরে যাই— তা হয়তো টেরই পাই না। ক্যারিয়ার গড়ার ভূত মাথায় চাপিয়ে বিলম্বে বিবাহ করে আমরা দাম্পত্য ক্যারিয়ার নষ্ট করছি নাতো! লাইফ স্যাটেল করতে করতে শেষে যদি লাইফটাই ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় যৌবনের বসন্তকাল! তবে স্যাটেল-সাকসেস-ক্যারিয়ার ইত্যাদি শব্দের মর্মটা আসলে কী? সমাজের অংকে জীবন কষা বড় কঠিন!
সুতরাং সামাজিক কুসংস্কার থেকে বিরত থেকে ইসলামের সুমহান আদর্শে নিজেকে সাজানোই প্রতিটি মোমিনের লাইফ স্টাইল হওয়া উচিত। এতেই নিহিত সত্যিকারের সুখ-শান্তি-সফলতা।
লেখক: গোলাম রাজ্জাক কাসেমী, মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান (আরবি ভাষা বিভাগ), মাহমুদিয়া মাদরাসা, নারায়ণগঞ্জ ।