বিদেশফেরত নারী কর্মীদের অধিকাংশই জরায়ু সমস্যায় আক্রান্ত

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ২ মাস আগে

বিদেশফেরত অসুস্থ নারী কর্মীদের বেশির ভাগই জরায়ু সমস্যায় আক্রান্ত। বিদেশে চিকিৎসা সেবা না পেয়েই দেশে ফিরেছেন অনেক প্রবাসী নারী শ্রমিক।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের আবেদনপত্র বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে।

আবেদনপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরে চিকিৎসা সহায়তার জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করেন নারী কর্মীরা। বিগত তিন বছরে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে চিকিৎসার জন্য অর্থসহায়তা চেয়ে আবেদন করেছেন প্রবাসফেরত ১২৫ নারী শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৫০ জনই জরায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত। কিডনির জটিলতা ও ক্যান্সারে আক্রান্ত যথাক্রমে ১৪ ও ১১ জন। এর বাইরে প্রবাসে শারীরিক নির্যাতনে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য অর্থসহায়তা চেয়েছেন ৫০ জন।

এসব নারীদের সবাই বিদেশ থেকে চিকিৎসাবঞ্চিত অবস্থায় দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে ৮৭ জনই ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। বাকিদেরও বেশির ভাগই এসেছেন জর্ডান, ওমান, লেবানন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে।

এ ব্যাপারে গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারজানা বেগম বলেন, ‘‌আমি এ ধরনের কিছু রোগীকে ফেস করেছি। কয়েকজনকে চিকিৎসা দিয়েছি। যতটুকু জেনেছি প্রবাসে তারা নিয়মিত চেকআপ করাতে পারেন না। অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন না। অনেকে দেশে ফেরার পর পরিবারের কাছে নিজের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য শারীরিক নির্যাতনের কথা গোপন রাখেন। মাঝবয়সী নারীদের জরায়ুর সমস্যা হতে পারে। আবার অস্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইলের কারণেও হতে পারে। এছাড়া সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজের কারণেও জরায়ু সমস্যা দেখা দিতে পারে।’

অসুস্থ বিদেশফেরত নারী শ্রমিকরা জানান, নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে অমানবিক আচরণের শিকার হতে হয়েছে তাদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগদাতারা অতিরিক্ত খাটালেও তাদের নিয়মিত খাবার খেতে দিত না। নিয়মিত যৌন ও শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়ন ও পরিশ্রমে অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের কাছে নেয়া হতো না তাদের।

২০২৪ সালে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে অর্থসহায়তার জন্য আবেদন করেছেন প্রবাসফেরত ৫৬ নারী। এর মধ্যে ২০ জন সহায়তা চেয়েছেন জরায়ু সমস্যার চিকিৎসার জন্য। বাকিদের মধ্যে কিডনির জটিলতা ও ক্যান্সারে ভুগছেন যথাক্রমে ১০ ও সাতজন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১৯ জন। ২০২৩ সালে সহায়তা চাওয়া প্রবাসফেরত ৪৪ নারী কর্মীর মধ্যে ২০ জন জরায়ুর সমস্যায়, তিনজন ক্যান্সারে এবং দুজন কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। বাকি ১৯ জন শারীরিক নির্যাতনে আহত অবস্থায় দেশে ফেরেন। ২০২২ সালে অর্থসহায়তার জন্য আবেদন করেছিলেন মোট ২৫ জন। তাদের মধ্যে ১২ জনই শারীরিক নির্যাতনের শিকার। জরায়ুর সমস্যায় ভুগছিলেন ১০ জন। কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন দুজন। ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন একজন।

প্রবাসে শ্রমিক হিসেবে যাওয়া এসব নারীর চিকিৎসাবঞ্চিত হয়ে দেশে ফেরার বিষয়টি নিয়ে সরকারের এখন তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সভাপতি অধ্যাপক ড. সি আর আবরার। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য দেশে ফেরত আসতে হবে এটি অন্যায়। ওই দেশের মালিকেরই চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত এটি চুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা এবং অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখা। এখানে অসুস্থতার যেসব তথ্য এসেছে, সংখ্যাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে নারী কর্মীরা কী ধরনের সমস্যায় পড়ছেন। সংখ্যাটা হয়তো আরো বেশি। তবে অনেকেই জানেন না যে কল্যাণ বোর্ড থেকে এমন অর্থসহায়তা দেয়া হয়। এটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার।’

প্রবাসে গিয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জমিলা (ছদ্মনাম)। গৃহকর্মী সৌদি আরবে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‌মেয়ে বিয়ে দিতে ঋণ করায় বিদেশে যাই। বেতন যা দেয়ার কথা, দেয়নি। তিন মাস পর ঠিকমতো খাবারও দেয়নি। সকালে শুধু রুটি আর চা দেয়া হতো। পাঁচ মাস পর অসুস্থ হয়ে পড়ি। চিকিৎসা দেয়নি। খাবার চাইলে বলত দূরে যা, কাজ কর। খাবার না পেলে কাজ করব কীভাবে। অসুস্থ হয়ে রুমে পড়ে থাকতাম, ওঠার মতো শক্তি ছিল না যে উঠে পানি খাব। ভাত চাইলেও দেয় না। খাবার খেয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে, সেই খাবার খেয়েছি। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। অসুস্থ হলেও ডাক্তার দেখায়নি। অফিসে যোগাযোগ করলে বলে পালিয়ে আসো। আমরা গাড়ি নিয়ে বাসার সামনে থাকব।’

বাসা থেকে পালিয়ে বাঙালিদের সহায়তায় এক বাসায় আশ্রয় পান জমিলা। সেখান থেকে থানা হয়ে দূতাবাসের আশ্রয়ে প্রায় এক মাস থাকার পর দেশে ফেরত আসেন তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান বলেন, ‘‌বিদেশফেরত যেসব আহত ও অসুস্থ কর্মী আমাদের এখানে অর্থসহায়তার আবেদন করেন, তাদের সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা চিকিৎসাসহায়তা দেয়া হয়। আমরা ঘটনাগুলো জানতে পারি দেশে আসার পর। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রবাসীদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। কতজন নারী কর্মী কোন কোন মালিকের অধীনে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে যদি মাসে একবার হলেও যোগাযোগ করা হতো; তাহলে অনেকটাই এসব সমস্যা কমে যাবে। এখানে দূতাবাসের সুপারভিশনের আভাব রয়েছে। কর্মীরা বিদেশে যাওয়ার পর তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না থাকার জন্য চিকিৎসাবঞ্চিত ও আহত হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন।’