সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে টানা ১০ দিন ইন্টারনেট বন্ধ রেখে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারী হয়েও রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে টেলিযোগাযোগ আইন বহির্ভূতভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন্স বিভাগের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং পরিশেষে নিয়োগ প্রাপ্ত হন চেয়ারম্যান হিসেবে।
চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পরপরই তিনি পুরো কমিশনে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপে সচেষ্ট হন। এলক্ষ্যে তিনি তার ঘনিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সাবেক প্রচার সম্পাদক মো. আমজাদ হোসেন নিপুকে (উপ-পরিচালক, প্রশাসন) নিজের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। যদিও মো. আমজাদ হোসেন উপ-পরিচালক, প্রশাসন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব হিসেবে নির্ধারিত কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও বিধি-বহির্ভূত ভাবে মো. আমজাদ হোসেনকে একান্ত সচিব হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়। যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিধি-১ শাখা হতে ১৮ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত চলতি ও অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান নীতিমালা, ২০২৩ বিধি-৪ এর সম্পূর্ণভাবে ব্যতয় হিসেবে পরিগণিত হয়।
একান্ত সচিব হিসেবে পদায়নের পর মোঃ আমজাদ হোসেন চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিটিআরসি’র বিভিন্ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের ঘনিষ্ট দেশবিরোধী ও দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদায়ন করেন এবং বিটিআরসি’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
বিটিআরসি’র বেশ কয়েক জন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, আমজাদ হোসেন প্রশাসন বিভাগের ক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে নেন। একই সাথে, চেয়াম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় আমজাদ হোসেন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও বিটিআরসি’র অন্যান্য কাজে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সরিয়ে বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ পদে তার অনুসারীদের পদায়ন করেন। এক্ষেত্রে বিটিআরসি’র ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন্স বিভাগে তার সহচর উপ-পরিচালক মাহদী আহমদ-কে যাবতীয় কমিটি ও কার্যক্রমে দায়িত্ব প্রদান করে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করেন। উল্লেখ্য, মাহদী আহমদ এর পিতা মাহফুজ উদ্দিন আহমদ গত আওয়ামী সরকারে আমলে তিন-তিন বার বিটিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে ৪৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে তিনি বর্তমানে দুদকের চার্জশিট ভূক্ত আসামী।
চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ তাদের নিজস্ব কর্মকর্তাগণের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স নবায়ন, টেন্ডার বাণিজ্য, অপারেশনাল কার্যক্রমে বিশেষ সুবিধা আদায় ও অন্যান্য বিভিন্ন দূর্নীতি ও অনিয়ম করেন। আইএসপিএবি (ইন্টারনেট লাইসেন্সধারীদের সংগঠন) এর পরিচালক এস এম জাকির হোসাইন (ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক) এর মদদে শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় সারাদেশের সাবেক ছাত্রলীগ/যুবলীগ/স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতাদের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে পাঁচ শতাধিক আইএসপি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এসকল দলবাজ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় দশ হাজার কর্মচারীকে এইবার ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের বিরুদ্ধে জোর করে মাঠে নামানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ফোন করে অন্যান্য আইএসপিদেরকেও এই আন্দোলনে না নামলে লাইসেন্স বাতিল করার ভয় দেখান আমজাদ হোসেন ও মাহদী আহমেদ।
সম্প্রতি সামিট কমিউনিকেশন্স লি. এর এনটিটিএন লাইসেন্সের শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফি ১০ কোটি বিধি বহির্ভূতভাবে মওকুফ করেন, যা লাইসেন্সিং গাইডলাইনের ব্যত্যয়। বিটিআরসি’র টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চেয়ারম্যান পূর্বের কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করে তার মূল সহযোগী আমজাদ হোসেনকে দায়িত্ব প্রদান করেন। এছাড়া, ক্রয় প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কমিটিতে আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান করেন। সম্প্রতি, রেডিয়েশন পরিমাপক সংক্রান্ত ১৫ কোটি টাকার দরপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পূর্বের কমিটি সংশোধন করেন। এক্ষেত্রে পিপিআর এর বিধি বহির্ভূতভাবে দরপত্র উন্মুক্ত করার মাত্র ১ ঘন্টা আগে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরিয়ে কমিটি সংশোধন করে আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করেন।
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে মাহদী আহমেদ একাই ক্রয় সংক্রান্ত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্ধ শতাধিক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, যা বিটিআরসি’র ইতিহাসে নজিরবিহীন।
কমিশনারকে (অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগ) এড়িয়ে চেয়ারম্যান তার সিন্ডেকেট সদস্য অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের পরিচালক অর্থ’কে ব্যবহার করে কমিশনের অর্থ ব্যবস্থাপনাতেও ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। চেয়ারম্যান ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের খরচ রাষ্ট্রীয় ফান্ড হতে ব্যয় করেন। তিনি সরকারের সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের ১৬০০ কোটি টাকা নিয়ে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। ১৬০০ কোটি টাকার মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ব্যাংক মুনাফা তাদের নিজস্ব একাউন্টে স্থানান্তর করেন। এছাড়া, সরকারি বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্পন্সর সংগ্রহের নামে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান হতে জোর জবরদস্তি করে চাঁদা সংগ্রহ করে ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা করার বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, মোস্তাফা জব্বার মন্ত্রী থাকাকালে আমজাদ হোসেন সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের ধারাবাহিক সভা আয়োজনের নামে আপ্যায়ন খাতে ভাউচার ছাড়া প্রায় ৫৩ লাখ টাকা তছরুফ করার অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট নথি গায়েব করা হয়। এ বিষয়ে বর্তমান চেয়ারম্যানকে অভিযোগ জানালে তিনি কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
চেয়ারম্যান সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য পরিচালক মো. নুরুন্নবী কে এনফোর্সমেন্ট এন্ড ইন্সপেকশন ডাইরেক্টরেট এর পরিচালক হিসেবে বদলি করে তার বিভিন্ন লাইসেন্সড অপারেটর এ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। এর ফলে কার্যত অপারেটরসমূহ অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয়।
বার বার অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি অপারেটর জানায়।
টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন গাইডলাইন, নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ ও আইটিইউ এর গাইডলাইন অনুসরণ না করার ফলে টেলিকম খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ শুন্যের কোঠায় এসে দাড়িয়েছে, যা সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব ফেলেছে।
সীমাহীন দলীয়করণ, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী কার্যক্রমের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলতা ও অব্যবস্থাপনা। কোন নিয়ম নীতির অনুসরণ না করার ফলে লাইসেন্সধারী অপারেটরদের মাঝে অসন্তোষ চরম মাত্রায় পৌছেছে। ফলশ্রুতিতে, পুরো সেক্টরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে, তারা যে কোন সময়ে বিটিআরসি ভবন ঘেরাও করার মত কর্মসূচি প্রদান করতে পারে মর্মে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। এছাড়া, বিটিআরসি এর সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে কোন সময়ে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনের ফলে সরকারের পতন ঘটলে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এ অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষিতে উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে পদ থেকে সরানো হলেও বিটিআরসিতে এই ধরনের দুর্নীতিবাজ এবং দলীয় পদধারিরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এখনো কেন তাদেরকে পদ থেকে সরিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খাত সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীরা। সেইসাথে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় যেকোনো সময় তারা বিদেশ পালিয়ে যেতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকেই।