বিজয়ের আকাঙ্খা : প্রতিষ্ঠিত হোক জাতীয় ঐক্য

::
প্রকাশ: ২ years ago

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া:
বিজয়ের ৫১ বছর চলছে, শেষ হতে চলছে বিজয়ের মাস। এর মাঝেই হিসাব চলছে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির। মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র ৯ মাসের লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আর লাল-সবুজের পতাকা। মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুণ, শোকাবহ, লোমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও বীরত্বপূর্ণ।

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নের বীজ বপন করেছিল সে বীজকে বাঙ্গালির স্বপ্নে পরিনত করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটেছে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত রয়েছে নানা অধ্যায় নানা ঘটনা। এর পরতে পরতে রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ২ বছরের মধ্যেই বাঙ্গালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও সালাম-বরকত-রফিকের আত্মত্যাগ, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্টির শোচনীয় পরাজয়, ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারন, ১৯৫৮ সােল আইয়ুবের সামরিক শাসন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা পেশ, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন ও শহীদ আসাদ-মতিউরের আত্মত্যাগ, ১৯৭০এর নির্বাচন, ১৯৭০ এ মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বর্জন ভোটের বাক্সে লাথি মারো পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিযাদিন’ উচ্চারন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সকল কিছুই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নিয়ামত সংগ্রামের অধ্যায়। এভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি তৈরি হয়।

পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু, জনগণের রায়ের প্রতি কোন রকম সম্মান প্রদর্শন করে নাই পাকিস্তানী শাসকগোষ্টি। জনগণ প্রত্যাশা যাতে পূরন না হয় সে লক্ষে পাকিস্তানের শাসকগোষ্টি-কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু সামরিক কর্মকর্তা-ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে এমনভাবে যেন শাসন ক্ষমতা কোনক্রমে বাঙ্গালীর হস্তগত না হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হন।

নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনে মত দিতে অস্বীকার করেন। তারা নানা নাটকের অবতারনা করার মধ্য দিয়ে কালক্ষেপনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। সামরিক শাসকগণ সরকার গঠন বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে আলোচনার নাটক শুরু করে। কিসের জন্য আলোচনা, এটা বুঝতে বাঙালি নেতৃবৃন্দের খুব একটা সময় লাগেনি। জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১লা মার্চ ১৯৭১ দেশব্যাপী অসহযোগের আহবান জানান। সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। ২রা মার্চ ৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালিন ডাকসু’র ভিপি আ স ম আবদুর রব। ৩রা মার্চ ‘৭১ এ রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর পক্ষ থেকে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করে তৎকালিন ছাত্রলীগ সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। সেই ইশতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঘোষনা করা হয়।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোন সমাধান না দেওয়ায়, ৭ই মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক দিকনির্দেশনী ভাষণে সর্বপ্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তত হতে আহবান জানান। এই ভাষণে তিনি বলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক বক্তব্যের পর পরই ৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বজ্রকন্ঠে উচ্চারন করেন ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেউ দাবীয়ে রাখতে পারবে না এবং এ ব্যপাওে কোন আপোষ সম্ভব নয়’। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ৯ মার্চ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর বক্তব্য সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী ও বিপ্লবী আগুনে পুড়িয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পৌঁছে দেয়, জাতির মাঝে রাষ্ট্রের অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়, জাতির অন্তরে বিপুল শক্তির জন্ম দেয়। ৯ মার্চ মওলানা ভাসানীর ভাষনের পর প্রধান দুই নেতা একসঙ্গে একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রকাশ করেন, তখন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। যদিও আজ ইতিহাস থেকে তা মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে অব্যাহতভাবে।

২৩ মার্চ ৭১ সকালে পল্টন ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে এই বাহিনীর নেতৃবৃন্দ মিছিল সহকারে বাংলাদেশের পতাকাসহ বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িতে এই পতাকা উত্তোলন করেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে এই পতাকা লাগান হয়। ২৩শে মার্চ পূর্ব বাংলার প্রতিটি শহরে পাকিস্তান দিবসের অনুষ্ঠান বর্জিত হয় এবং পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়। সেই সময় ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পল্টনে মওলানা ভাসানীর পক্ষে তৎকালীন ন্যাপ সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া পল্টন ময়দানে দলের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার দাবী তুলে ধরেন এবং পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলেন।

অন্যদিকে ক্ষমতার হস্তান্তরের নামে এই আলোচনা চলা অবস্থায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জুলফিকার আলী ভুট্টো সৃষ্ট সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে নতুন করে সংকটের সৃষ্টি করে। অযৌক্তিক দাবি উপস্থাপনের ফলে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধানের পথ এক সময় রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ২৪শে মার্চ ৭১ সামরিক শাসকগণ হেলিকপ্টার যোগে সমস্ত সেনানিবাসে এই আক্রমণের পরিকল্পনা হস্তান্তর করে। বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞের নির্দেশ নামা “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে পরিচিতি।

২৫শে মার্চ ৭১ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে সেনানিবাস অথবা আক্রমণ প্রস্তুতি স্থানগুলি ত্যাগ করে। একই সাথে ঢাকাসহ দেশের সমস্ত বড় শহর ও সেনানিবাসের বাঙালি রেজিমেন্টসমূহ আক্রান্ত হয়। সেনাবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু রাত ১২টা ৩০ মিনিটে ধানমন্ডি বাসভবন থেকে বন্দী হবার পূর্বে তিনি দলীয় নেতৃবন্দেকে করণীয় বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহবান জানান। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

২৭ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণা পাঠ করেন। এই ঘোষণাটিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র: মুজিবনগর প্রশাসন, তৃতীয় খন্ড, প্রকাশকাল: নভেম্বর ১৯৮২)

১০ই এপ্রিল ৭১ নির্বাচিত সাংসদগণ আগরতলায় একত্রিত হয়ে এক সর্বসস্মত সিদ্ধান্তে সরকার গঠন করেন। এই সরকার স্বাধীন সার্বভৌম “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার”। স্বাধীনতার সনদ (Charter of Independence) বলে এই সরকারের কার্যকারিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ১৭ই এপ্রিল ৭১ মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামে বৈদ্যনাথ তলায় “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার” আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির এই সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের শপথ পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পীকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী। যে সমস্ত নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় তাঁরা হলেন : রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি), প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান। এই অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে) এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে সরকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশ বিদেশের শতাধিক সাংবাদিক ও হাজার হাজার দেশবাসীর উপস্থিতিতে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাংসদ জনাব আবদুল মান্নান। নবগঠিত সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই স্থানটির নামকরণ করা হয় “মুজিব নগর”।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সর্বসম্মতিক্রমে একটি “সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ” গঠন করেন। এই উপদেষ্টা পরিষদ ছিল : মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (সভাপতি, ন্যাপ) প্রধান উপদেষ্টা, কমরেড মনি সিং (সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি), অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ (সভাপতি, ন্যাপ মোজাফ্ফর), শ্রী মনোরঞ্জন ধর (সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস) প্রবাসী সরকারের পক্ষে তাজউদ্দিন আহমেদ (প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারবলে), খন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদাধিকারবলে)।

এই সরকারের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা উপস্থাপনসহ এবং একটি সময় উপযোগী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের অত্যাচারে প্রায় এক কোটি বাঙালি দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ দেশত্যাগী এই জনগোষ্ঠীর সার্বিক সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা দান করেন। ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দরা গান্ধি এসময় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।

১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবিদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে।

১৬ই ডিসেম্বর ‘৭১ বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়র্দী উদ্যান) পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পূর্বাঞ্চলের মিত্র বাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ কে নিয়াজী। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপ-সেনা প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন এস ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার এবং টাঙ্গাইল মুক্তি বাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। এই দিনটি বাঙ্গালির ”বিজয় দিবস”।

ডিসেম্বর মাস বাঙালির বিজয়ের মাস। এই মাসটা এলেই মনে করিয়ে দেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, কত বীরত্ব ও অসামান্য আত্মত্যাগের কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভের এই মাসটিকে আমরা বড় আবেগের আনন্দ ও বেদনা নিয়ে উদযাপন করি। এই দিনটি দেশ এবং জাতির জন্য গৌরবের দিন। আনন্দ বিজয়ে, বেদনা লাখো শহীদের আত্মদান আর রক্তের স্রোতের কারণে। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের প্রাণে গর্ব ও গৌরবের বাঁশি বাজায়। কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ কতটা সর্বজনীন সোনার বাংলাদেশ হতে পেরেছে তা আমাদের ভাবনায় খুব কমই আসে। একবারও কি ভেবে দেখেছি যে, স্বাধীন বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কতটা অগ্রসর হয়েছে? একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের সার্বিক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে কতটা ফারাক রয়েছে? নাকি আদৌ কোন ফারাক নেই! বিষয়টি তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার দিকে তাকাই। দেখতে পাই- উচ্চবিত্ত, শ্রেণি বিশেষ এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের ভাগ্যই কেবল উন্নতির দিকে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে নিম্নবিত্ত তথা কৃষক-শ্রমিক ও কারিগর শ্রেণির মানুষের ভাগ্যে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি দেশের সাধারণ মানুষের। জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত তাদের একমুঠো ভাত যোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই! সর্বদা সুবিধাভোগীরা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সূচক পূরণে যতটা এগিয়ে যাচ্ছেতার চেয়ে সুবিধাভোগীরাই বেশি সমৃদ্ধি লাভ করছে। সুবিধাভোগীরা বাঙালী, আর বঞ্চিতরাও বাঙালী। আর এই অর্জন কেবলমাত্র শ্রেণি বিশেষের জন্যই যুদ্ধে অর্জিত বিজয় তা প্রমাণ করে দিয়েছে। স্বাধীনতা তথা বিজয়ের মাস নিয়ে গর্ব কি শুধু সমৃদ্ধ শ্রেণির জন্যই? সমাজ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতেই থাকবে? তবে কি এই অবস্থা থেকে এদেশের সাধারণ মানুষ রেহাই পাবে না? এ প্রশ্ন আজ সমাজের সচেতন ও বিবেকবান সব মানুষের।

পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি – নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক,মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেক মহান নেতাকে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও কঠিন হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত না হলে রাষ্ট্রও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে। একটি গণতান্ত্রিক, সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়েই বীর মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সা, অপরাজনীতি ও অহমিকার কারণে আমাদের স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তির প্রক্কালে বলতে হয় সে প্রত্যাশা এখনও পরিপূর্ণ পূরণ হয়নি; বরং অর্জন যৎসামান্যই বলতে হবে।

স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তির বছরে বলতে হয়, এ দীর্ঘ সময়ে আরও অনেক উন্নয়ন হবার কথা ছিলো; কিন্তু তা হয়নি। বিগত বছরগুলোতে স্বনির্ভরতা, সোনার বাংলা, দারিদ্র্য বিমোচন, সবার জন্য শিক্ষা, একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ইত্যাদি নানান ধরনের কর্মসূচি গৃহীত হলেও ৫১ বছরে বাংলাদেশের অর্জন আশানুরূপ নয়। এই জন্য একদিকে যেমন জনসংখ্যার আধিক্য, শিক্ষার অভাব, দাতাদেশ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কঠিন শর্ত আরোপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দায়ী; অন্যদিকে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়।

স্বাধীনতার সুফল অর্জন ও তা জনগনের দ্বারে পৌঁছিয়ে দিতে হলে এসব সমস্যার সমাধানে সকলকে বিশেষভাবে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। খুজে বের করতে হবে আমাদের প্রত্যাশিত উন্নতি অর্জিত হচ্ছে না কেন? এসবের কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করতে হবে। দেশে কল্যাণকামী সকলকে, সকল রাজনৈতিক দলকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থকে স্থান দিতে হবে। কথায় ও কাজে এক হতে হবে। তবেই হবে দেশের উন্নতি, তবেই হবে দেশের কল্যাণ।

যে রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের জন্ম সেই ইতিহাসকে যথাযথ উপলব্ধি করাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার মধ্যে দাবি আদায়ের আদর্শ রয়েছে, মুক্তির স্বপ্ন আছে আর আছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার মূল্যবোধ। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবাধিকার মহান বিজয় দিবসের অন্যতম প্রত্যয়। প্রত্যাশা করি সুবর্ণ জয়ন্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় ঐক্য। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে ঐক্য।

লেখক: রাজনীতিক, কলাম লেখক।
          মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ এবং আহ্বা্য়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন।