সচ্ছল বড় গৃহস্ত পরিবারে বাবার জন্ম। দাদীর দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। গ্রামের ছোট-বড় সবাই তাঁকে চিনতেন। নাম আনোয়ার হোসেন, তবে সবাই আনু বলে ডাকতেন। বাবা সুদর্শন ছিলেন। গায়ের রঙ ছিল দুধে আলতা। সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। সততার সাথে জীবনযাপন করতেন। নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করেছেন। বিনিময়ে কোনো প্রতিদান নেননি। তিনি ছিলেন আমাদের আদর্শ। ভাই-বোনদের প্রতি বাবার আদেশ ছিল, বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ করা এবং জীবনে সৎ পথে চলা।
বাবা একটু রাগী ছিলেন বটে। যেমন শাসনে রাখতেন তেমন ভালোবাসতেন। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বাবা ছুটি নিয়ে আমাদের নানা বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। নানা বাড়িতে আমাদের রেখে বাবা দুই-তিন পর কর্মস্থলে ফিরে যেতেন। আমরা অনেক দিন নানা বাড়িতে বেড়াতাম। দাদা বাড়িতে আমরা খুব কম যেতাম। কারণ বাবা ছোটবেলায় দাদীকে হারান, আর আমাদের ভাই-বোনদের জন্মের আগেই দাদাও মারা যান। দাদা-দাদী জীবিত না থাকায় তেমন যাওয়া হতো না। আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে কোনো ছাড় ছিল না। নতুন বছর, নতুন অনুভূতি। চকচকে বাহারী রঙের মলাটে নতুন বই। অপেক্ষায় থাকতাম। বাবা লাইব্রেরি থেকে কিনে আনতেন। আমাদের হাতে তুলে দিতেন। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হতাম। বই হাতে নিয়ে শুরু হতো হইহুল্লোর। বাবা ভাই-বোনদের চোখেমুখে দেখতেন আনন্দের ছাপ। তিনি কখনো আমাদের পুরাতন পাঠ্যবই কিনে দেন নাই।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
বাবা চাকরি করতেন। মাস শেষে বেতন পেয়ে আমাদের ভাই-বোনদের প্রত্যেককে একটি করে নতুন দশ টাকার নোট দিতেন। টাকা পেয়ে আমরা এতই খুশি হতাম, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
ঈদ ছিল মহা খুশির এবং আনন্দের একটা দিন। বিশেষ করে রোজার ঈদ। ঈদের আনন্দকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিতেন বাবা। আমাদের ভাই-বোনদের যার যার পছন্দের নতুন জামা-প্যান্ট, জুতা কিনে দিতেন, কিন্তু নিজের জন্য কিছু কিনতেন না। কেন কিনতেন না, তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি। বাবার সামান্য ঈদ বোনাসে আমাদের জন্য কেনাকাটার পর তার জন্য কেনার টাকা থাকত না। আমাদের আনন্দের জন্য তিনি নিজের আনন্দকে এভাবে বিলিয়ে দিতেন। বাবারা বুঝি এমনই হয়। সন্তানদের আনন্দের জন্য নিজের সব সুখ আহ্লাদ এভাবেই বিসর্জন দেন।
বাবা বহু রোগের চিকিৎসা জানতেন। উদ্ভিজ্জ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে ওষুধ বানাতেন। এতে অনেক রোগী ভালও হয়েছেন। দুইটি ঘটনা আমার আজও মনে আছে। নানার গ্রামে এক মেয়ের গলায় গ্যাক (গলগন্ড রোগ) ছিল। দেশের অনেক ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়েও মেয়েটির গলার গ্যাক ভালো হয় নাই। অবশেষে বাবার তৈরি ওষুধ খাওয়ায় মেয়েটির রোগ ভালো হয়ে যায়। ঢাকার এক দীর্ঘদিনের রক্ত আমাশয় রোগী বাবার চিকিৎসাতে রোগমুক্ত হন। অনেক চিকিৎসা করেও তাদের রোগ ভালো হয় নাই, বাবার উদ্ভিজ্জ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে হাতে বানানো ওষুধে রোগ নিরাময়ে উনারা চিকিৎসা ফি হিসেবে টাকা দিতে চাইলে বাবা তা গ্রহণ করেননি। কারণ বাবা অর্থের বিনিময়ে নয়, বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসা করতেন।
বাবা নিজের গ্রাম ও মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি গ্রামের প্রতিটি মানুষ বাবাকেও খুব ভালোবাসতেন। বাবা গ্রামের বাড়িতে গেলে প্রতিটির পাড়ার প্রায় সব বাড়ি থেকেই লোকজন বাবার সাথে দেখা করতে আসতেন। আমাদের গ্রামে বড় একটি বিল ছিল। বাবা সবাইকে নিয়ে দল বেঁধে পলো দিয়ে মাছ ধরতেন। ওইদিন ছিল গ্রামবাসীর উৎসবের দিন। আগেই বলেছি, বাবাকে গ্রামের সবাই চিনতেন। শুধু নিজ গ্রাম না আশপাশের আট-দশটি গ্রামের লোকজনও বাবাকে চিনতেন। একবার আমাদের প্রাইভেট শিক্ষক ইসমাইল স্যারের ছোট ভাই (হারুন কাকা) বাবার সাথে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি বাবাকে স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত পথিমধ্যে মানুষের সালামের উত্তর ও কুশল বিনিময় দেখে বলেই ফেললেন, ভাই আপনার মুখ তো ব্যথা হয়ে যাবে, এক কাজ করেন ‘আমি ভালো আছি’কাগজে লিখে শার্টে লাগিয়ে রাখুন, তাহলে মুখে জবাব দিতে হবে না। বাবার প্রতি গ্রামের মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাবা আজ নেই তবুও বেঁচে আছে গ্রামের মানুষের অন্তরে।
বাবা সব সময় আমাদের ভালো রাখার সাধ্য মতো চেষ্টা করতেন। সেই বাবার জন্য কিছুই করতে পারি নাই। না পারার ক্ষত চিরকাল বুকের ভিতর বেদনা হয়ে রয়ে যাবে। ২০০০ সালের জুলাই মাসে চাকরিতে যোগদান করি। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে বাসায় ফিরে বেতনের টাকা মায়ের হাতে তুলে দেই। সেই টাকা থেকে মা বাবাকে পাঁচশত টাকা দেন। বাবা টাকা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। টাকাটা খরচ করতে পারেন নাই, বাবার পকেটেই রয়ে যায়। কোনো দিন খরচ করতেও পারবেন না। ইচ্ছে ছিল ঈদে বাবাকে নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনে দিব। তা পরে ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাবেন। সেই ইচ্ছে আমার পূরণ হলো না। তার আগেই বাবা চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ঈদ এলে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের জন্য কেনাকাটা করি। শুধু কেনা হয় না আমার প্রিয় জন্মদাতা বাবার জন্য। এটা যে কত কষ্টের, কত বেদনার তা বলে বোঝানো যাবে না।।
২০০০ সালের ১৩ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাবা। বি ও এফ কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাবা। আমিও দুই সন্তানের বাবা। আজ সব বুঝতে পারি, তোমার সব সুখ-আহ্লাদ বিসর্জনের কারণ। কেন নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছ। কারণ তুমি তো ছিলে বাবা, আমার বাবা, আমাদের বাবা। বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। বেঁচে থাকতে কখনো বলতে পারিনি। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, বাবা তোমাকে ভালোবাসি! বড্ড ভালোবাসি। বাবা ভালো থেকো ওপারে।
লেখক: মো. নবী আলম, উন্নয়ন কর্মী ও সাংবাদিক।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net