রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। গত ২১ জানুয়ারি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ২৮তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের বাণিজ্য মেলার লে-আউট প্ল্যান অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরির মোট প্যাভিলিয়ন, রেস্তোরাঁ ও স্টলের সংখ্যা ৩৫১টি এবং দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত প্যাভিলিয়ন, রেস্তোরাঁ ও স্টলের সংখ্যা ৩০০টি। মেলা প্রাঙ্গণের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে এগিয়ে নিতে এবার কর্ণফুলী টানেলের আদলে মেলার প্রবেশ করা হয়েছে। একপাশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং অন্যপাশে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে এগুলো দৃশ্যমান করা হয়।
পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশীয় পণ্য রফতানিতে বহুমুখীকরণ করাই বাণিজ্য মেলার মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ যদি তার পণ্য বহুমুখীকরণ করতে পারে, তাহলে আমাদের রপ্তানি ১০০ বিলিয়নের বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ মেলা স্থিতিস্থাপকতার সাথে দ্রুত প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে, যা উচ্চমানের উন্মুক্তকরণ প্রচেষ্টার একটি হাইলাইট হিসাবে আবির্ভূত হয়।
ইপিবি জানায়, এবারের বাণিজ্য মেলায় দেশীয় পণ্য ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ অংশ নেবে। পণ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি দেশীয় পণ্য রফতানির জন্য বড় বাজার খুঁজে বের করার লক্ষ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ইপিবির যৌথ উদ্যোগে দেশীয় পণ্যের প্রচার, বিস্তার, বাজারজাতকরণ ও সহায়তার লক্ষ্যে ১৯৯৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শেরেবাংলা নগরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কোভিড মহামারির কারণে ২০২১ সালে মেলা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। মহামারী বিধিনিষেধের মধ্যে ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো পূর্বাচলে বিবিসিএফইসি-তে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্থায়ী ভেন্যু বাংলাদেশ-চীন এক্সিবিশন সেন্টারে তৃতীয়বারের মতো বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চীনের অর্থায়নে পূর্বাচলে একটি স্থায়ী বাণিজ্য মেলা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এখন থেকে প্রতি বছর এখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হবে। কম্পিউটার মেলা, বিজ্ঞান মেলা, কৃষি মেলা ও বইমেলার মতো মেলা আমাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে আধুনিক সংস্করণ ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে নিয়মিতভাবে এ মেলার আয়োজন করা হলেও বর্তমানে মেলার ভেন্যু পরিবর্তন করে বর্তমান স্থানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্বকীয়তা, সৌন্দর্য এবং মানের দিক থেকে সেরা পণ্য পাওয়া যায় বলে মেলাটি বিপুল সংখ্যক লোককে আকর্ষণ করে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে বরাবরের মতো জানুয়ারি মাসে শুরু হয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। মেলার আন্তর্জাতিকীকরণের কারণে অনেক বিদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। বিদেশি ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা ভিড় জমায়। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। মেলায় বিদেশি দর্শনার্থীদের কাছে এসব পণ্য বিক্রি করলে বিশ্বে আমাদের দেশীয় শিল্পের বিক্রি ও সুনাম বাড়ে। ফলে আমাদের ক্ষুদ্র শিল্পগুলো লাভবান হতে পারে। আর বড় দেশীয় কোম্পানির মুনাফা অর্জনের পথও সুগম হয় এই মেলার মাধ্যমে। এছাড়া অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকে বাংলাদেশ সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পায় এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ পায়। মেলার টিকিট বিক্রি থেকেও প্রচুর টাকা আয় হয়। মেলায় খণ্ডকালীন চাকরির মাধ্যমে বেকারদের সাময়িক বেকারত্ব দূর করা হয়। অনেকে মেলায় খণ্ডকালীন চাকরিতে ভালো দক্ষতা দেখিয়ে স্থায়ী চাকরিও পান। বাণিজ্য মেলা একটি দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সাথে সম্পর্কিত।
বাণিজ্যের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী মেলায় পরিণত হওয়া বাণিজ্য মেলার কার্যকারিতা উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করছে। বাণিজ্য মেলা ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, ব্যবসা খাতের জন্য নিজস্ব শক্তি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি ঘোষণার একটি মূল্যবান সুযোগ।
দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের জন্য, মেলায় অংশগ্রহণ ব্র্যান্ড সচেতনতা তৈরি, তাদের গ্রাহক বেস প্রসারিত এবং নতুন ব্যবসায়িক নেতৃত্ব তৈরি করার একটি দুর্দান্ত সুযোগ হতে পারে। তারা সম্ভাব্য অংশীদার এবং গ্রাহকদের সাথে দেখা করতে পারে, নতুন বাজারগুলি অন্বেষণ করতে পারে এবং সর্বশেষ শিল্প প্রবণতা এবং উন্নয়ন সম্পর্কে শিখতে পারে।
তদুপরি, মেলাটি ক্ষুদ্র এবং মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলিকে বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর সংস্থাগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য একটি স্তরের খেলার ক্ষেত্র সরবরাহ করে। এটি তাদের জন্য তাদের মানের পণ্য এবং পরিষেবাদি প্রদর্শন করার একটি দুর্দান্ত সুযোগ, যা তাদের স্বীকৃতি অর্জন করতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে।
মেলা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেলাটি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দেশের ব্যবসায়ের পরিবেশ সম্পর্কে জানার, সম্ভাব্য অংশীদার এবং সরবরাহকারীদের সাথে সাক্ষাৎ এবং বিনিয়োগের সুযোগগুলি অন্বেষণ করার সুযোগ দেয় যা বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সহায়তা করেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রাখছে।
অর্থাৎ বাণিজ্য মেলা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই দেশের প্রধান জ্বালানি অর্থনীতির সমৃদ্ধ অবকাঠামো গড়ে তুলতে বাণিজ্য মেলার আয়োজন করা প্রয়োজন। তাছাড়া মেলায় বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা তাদের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে হাজির হওয়ায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা সর্বশেষ বিদেশি পণ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলো নতুন পণ্যের আইডিয়া পায়। ক্রেতা বা ভোক্তারা বিদেশি পণ্যের সঙ্গে আমাদের দেশীয় পণ্যের মানের তুলনা করতে পারেন। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিদেশি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত ও সম্প্রসারিত হয়। বাণিজ্য জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রধান বাহক। আর এই বাণিজ্যের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণই বাণিজ্য মেলার মূল লক্ষ্য। দেশের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং অব্যাহত থাকবে। এই মেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক আয়োজন। উৎপাদক-রপ্তানিকারক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসা এবং পণ্যের প্রচার ও বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে এ মেলার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
লেখক: অনুপ সিনহা; গবেষক এবং ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]