বাংলাদেশ-ভুটান ট্রানজিট চুক্তির গুরুত্ব

::
প্রকাশ: ২ years ago

গত ২২ মার্চ, বাংলাদেশ এবং ভুটান একটি ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির আওতায় এখন হতে ভুটান ট্রানজিট ফি প্রদানের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্থল, আকাশ ও নৌপথ ব্যবহার করে অন্য কোন দেশের সাথে পণ্য আদান-প্রদান করতে পারবে। ভুটান একটি স্থলবেষ্টিত দেশ হওয়ায় এটি সাধারণত আমদানী-রপ্তানির জন্য এর প্রতিবেশী দেশগুলির ট্রানজিট পরিসেবার উপর নির্ভরশীল। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তিটি ভুটানের জন্য নানাবিধ সুফল বয়ে আনবে। অন্যদিকে, ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। ভারতের পর ভুটান দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ট্রানজিট সুবিধা গ্রহণ করছে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ এবং ভুটান উভয়ের জন্য এই ট্রানজিট চুক্তিটি সম্ভাবনাময় গুরুত্ব বহন করে।

বাংলাদেশ-ভুটান ট্রানজিট চুক্তি

২২শে মার্চ ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং ভুটানের প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী লিয়নপো কারমা দর্জি। চুক্তির আওতায় তৃতীয় কোনো দেশের সাথে পণ্য আমদানী-রপ্তানির ক্ষেত্রে ভুটান বাংলাদেশের স্থল, আকাশ ও জলপথ ব্যবহার করতে পারবে। বিনিময়ে, দেশটি বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় ফি এবং কর প্রদান করবে।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুটান মূলত মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী। এবং সেখান থেকে স্থল ও নৌপথ ব্যবহার করবে। চুক্তিটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর আগে বাংলাদেশ এবং ভুটান ২০২১ সালে একটি প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

ভুটানের জন্য চুক্তির গুরুত্ব

ভুটান একটি স্থলবেষ্টিত দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্র হওয়ায় এর সরাসরি রপ্তানি ও আমদানি মেটানোর সুযোগ নেই। আমদানী-রপ্তানির জন্য দেশটি তাই সীমান্তবর্তী এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। এ দিক থেকে ট্রানজিট চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াবে। অন্যদিকে, ভুটান দীর্ঘদিন ধরে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এই ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ভুটানের বাণিজ্যপথ বহুমুখী হবে। তাছাড়া ভুটান ভারতের উপর তার ট্রানজিট নির্ভরতা কমাতে পারার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। ভুটানে চীন-ভারত বৈরিতা রয়েছে। একারণে, ভারতের উপর ট্রানজিট নির্ভরতা কমিয়ে আনা গেলে ভূ-রাজনৈতিক চাপ কমিয়ে রাজনৈতিকভাবেও ভুটান উপকৃত হবে। ট্রানজিট চুক্তি বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কও বৃদ্ধি করবে। কেননা, ভুটানি ব্যবসায়ীরা লজিস্টিকস সহায়তার জন্য বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখবে। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।

 

বাংলাদেশের জন্য চুক্তির সম্ভাব্য গুরুত্ব

চুক্তিটির ফলে মংলা বন্দরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে। ফলে, চুক্তিটি বাংলাদেশকে মংলা বন্দরকে অধিকতর ব্যবহারে সহায়তা করবে। চুক্তির ফলে মংলা বন্দর ছাড়াও নদীবন্দরগুলোতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়বে। তাছাড়া, ভুটানি পণ্য স্থানান্তর করলে কর ও ট্রানজিট ফি আদায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে।

রাজস্ব, ফি এবং করের পাশাপাশি এটি স্থানীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে। ভুটানি পণ্য স্থানান্তরের ফলে দেশের পরিবহন খাতের ব্যবসা বাড়বে। স্থানীয় পর্যায়ে ট্রানজিট ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। ‘রাস্তার দুইপাশের’ অর্থনীতিতেও বাড়তি ব্যবসার যোগান দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্যে যে, চুক্তিটি অনেক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করবে, তবে বাংলাদেশ এবং ভুটান কতখানি সুবিধা পাবে তা নির্ভর করছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভুটানের পণ্য পরিবহনের পরিমাণের উপর।

এছাড়াও, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তিটি বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। দুই বছরের মধ্যে দেশটির মধ্যে এটি দ্বিতীয় চুক্তি। এর আগে, ২০২১ সালে, ভুটান এবং বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর করেছিল। দেশদুটি বর্তমানে তাদের মধ্যে কৃষি বাণিজ্য বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করছে।

দ্বিপাক্ষিক ও আর্থিক লাভের পাশাপাশি চুক্তিটি বাংলাদেশের ট্রানজিট পরিসেবা প্রদানের তালিকায় একাধিক দেশের স্থান হবে। ভুটানের আগে বাংলাদেশের একটি মাত্র ট্রানজিট গ্রহীতা ছিল ভারত। একাধিক দেশকে ট্রানজিট পরিবেসা প্রদান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলি যেমন নেপালকে বাংলাদেশের ট্রানজিট পরিসেবা গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে।

চুক্তিটি আঞ্চলিক সংযোগের উপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বেশ কিছুদিন ধরেই, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য এশীয় রাষ্ট্রগুলি তাদের মধ্যে সড়ক সংযোগ, ট্রানজিট সুবিধা এবং ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ট্রান্স-এশিয়ান সংযোগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলি র কাছে বাংলাদেশের বাণিজ্য রুট খুলে দেওয়া ভবিষ্যতের আঞ্চলিক সংযোগের জন্য একটি উদাহরণ এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

চুক্তিটি শুধু স্বাক্ষরকারী দেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও উপকার বয়ে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যোগাযোগ বৃদ্ধি ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের প্রসার একটি অন্যতম এজেন্ডা। এছাড়াও এশিয়ার মহাদেশীয় রাজনীতিতেও আন্তযোগাযোগ বৃদ্ধি এবং রিজিয়নালিজম বা আঞ্চলিকতা আনয়নের একটি প্রচেষ্টা রয়েছে। সুতরাং, এই ট্রানজিট চুক্তি ভবিষ্যতে এই প্রচেষ্টাকে অনুপ্রেরণা যোগাবে এবং ভবিষ্যতে এসংশ্লিষ্ট আলোচনায় একটি রেফারেন্স হিসাবে কাজ করবে। চুক্তিটি বাংলাদেশ-ভুটান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে, বিশেষ করে ২০২১ সালের পিটিএ চুক্তির পরে। পরিশেষে বলা যায়, এটি একটি প্রশংসনীয় চুক্তি।

লেখক: মো. মুফাসসির রশীদ; গবেষক, কেআরএফ সেন্টার ফর বাংলাদেশ এন্ড গ্লোবাল এফেয়ার্স (সিবিজিএ)।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net