বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত এবং সবচেয়ে বড় দাতা দেশ জাপান। সাম্প্রতিক সময়ে এ তিনটি দেশের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন হয়েছে বেশ ঘনিষ্ঠ, যা কিনা বদলে দিতে পারে ভারত-প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতির গতিপথ।
২০১২ সাল থেকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দাতা দেশ জাপান। দেশটির সহায়তার তালিকায় বাংলাদেশ নাম সবার আগে। এরই ধারাবাহিকতায় জাপান বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। বিশেষ করে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরটি উল্লেখযোগ্য। এই প্রকল্পটি জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ‘বে অব বেঙ্গল গ্রোথ বেল্ট’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচিত।
খুব একটা পিছিয়ে নেই ভারতও। বাংলাদেশের নিকটতম এই প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোয় সহযোগিতা করেছে। এরই লক্ষ্যে ভারতের নুমালিগড় থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুর পর্যন্ত ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধির অন্যতম উদাহরণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
এতদিন ভারত-বাংলাদেশ এবং জাপানের সম্পর্ক স্রেফ বাণিজ্যিক থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা ভিন্ন খাত বিশেষ করে নিরাপত্তা খাতে সম্প্রসারিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত এপ্রিলে ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ, ভারত এবং জাপানের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে তিন দেশের মধ্যে নিরাপত্তা খাতে আরও সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। বিষয়টি থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নয়া দিল্লি এবং টোকিও বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব বাড়ার বিষয়টি নিয়ে সতর্ক এবং উদ্বিগ্ন।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশকে নিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ‘বে অব বেঙ্গল-নর্থইস্ট ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালু চেইন কনসেপ্ট’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আওতায় জাপান গত মার্চে জাপান বাংলাদেশে ১৬৫ বিলিয়ন ইয়েন বা ১২০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ইয়েন এরই মধ্যে ছাড় করার কথাও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সহযোগিতা করার পেছনে ভারতের মূল স্বার্থ হলো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন ধরনে হুমকির উত্থান রোধ করতে ঢাকার সহায়তা নিশ্চিত করা।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত এবং জাপানের যে কর্মতৎপরতা তা উভয় দেশের স্বার্থে। যেখানে জাপান চায় দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তৃত হোক এবং ভারতও চায় তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর তার প্রভাব বজায় থাক। দুটি বিষয়টি পরস্পরের সঙ্গে একই বিন্দুতে মিলিত হয়ে যায় কারণ ভারত এবং জাপান পরস্পরের মিত্র।
শীতল যুদ্ধের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার সাথে জাপানের সম্পর্ক ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু সময়ের সাথে টোকিও এই অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বকে ক্রমবর্ধমানভাবে উপলব্ধি করছে। বিশেষ করে পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যবর্তী সমুদ্রপথে অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে নয়া দিল্লি। এসবের মধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল এবং ভারতের সরকারে মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি, বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন এবং ইন্ডিয়ান ওশেন রিম অ্যাসোসিয়েশন উল্লেখযোগ্য। এসব উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশ নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে। বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
এই অঞ্চলে অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগের জন্য জাপানের ক্রমবর্ধমান উত্সাহ বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে সংযোগ জোরদার করতে পারে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভারত এবং জাপানের সফট পাওয়ার বাড়ানোর প্রচেষ্টারই প্রতিনিধিত্ব করে।
জাপান এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে জাপানের বর্তমান প্রচেষ্টা এই দুই দেশে জাপান সম্পর্কে আরও ইতিবাচক ধারণার জন্ম দেবে এবং এ অঞ্চলে জাপানের কূটনৈতিক ভাবমূর্তি আরও বাড়িয়ে তুলবে বলেই অনুমান করা যায়।
ভারতও জাপানের মতো নিজের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন রপ্তানি করার চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টা ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের ইতিবাচক চিত্র নির্মাণে সহায়তা করেছে।
এটি স্পষ্ট যে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চারপাশে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং সামরিক উপস্থিতি, বিশেষ করে বন্দর এবং অন্যান্য কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রে এবং বাংলাদেশ এবং ভারতের অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেইজিংয়ের গভীর সম্পর্ক জাপান ও ভারত উভয়কেই শঙ্কিত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ই জাপানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কেবল তাই নয়, ভারত ঐতিহাসিকভাবেই দক্ষিণ এশিয়াকে তার ‘কৌশলগত উঠোন’ হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে চীনের ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি এড়ানোর জন্য তাকে অবশ্যই নতুন উপায় খুঁজেতে হবে। এ পরিস্থিতিতে জাপানের অর্থনৈতিক সহায়তা চীনের প্রভাব মোকাবেলায় ভারতের জন্য মূল্যবান রসদ হিসেবে হাজির হতে পারে।
সবমিলিয়ে নয়াদিল্লি, টোকিও এবং ঢাকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান বন্ধন এবং সহযোগিতা এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে পাশ কাটানো এবং একটি নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে জাপানের ভূমিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার সেরা নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক হিসেবে ভারতের ভূমিকাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
(মূল লেখা: নিক্কেই এশিয়ার নিবন্ধ)
ভাষান্তর: কামাল উদ্দিন মজুমদার; গবেষক, অনুবাদক ও কলামিস্ট।