সম্প্রতি ত্রিপুরায় নির্বাচনী গণসমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন বিজেপি সরকারের আমলে ত্রিপুরায় যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি আরো বলেন যে উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি কাজকর্ম ও আদান-প্রদান বেড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ধীরে ধীরে আরও মজবুত হচ্ছে। ত্রিপুরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার “গেটওয়ে” বা প্রবেশদ্বারে পরিণত হচ্ছে। ত্রিপুরা থেকে এখন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন মোদি।
নরেন্দ্র মোদি এরূপ মন্তব্য শুধু শুধু করেননি। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, বাংলাদেশ যদি ভারত-অবরুদ্ধ হয়, তবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যটি বাংলাদেশ-অবরুদ্ধ। বাংলাদেশ-ত্রিপুরা সীমান্তটি ৮৫৬ কিলোমিটারের বেশি প্রসারিত, যা ত্রিপুরার সীমান্তের ৮৫ শতাংশ গঠন করে। এই বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মধ্যে সম্পর্কটি শুধুমাত্র অবরূদ্ধ সীমান্তের নয়, বরং, এই সম্পর্ক ঐতিহাসিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক। প্রাচীনকাল থেকে, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের জনগণ তাদের সমস্যা এবং সমৃদ্ধি ভাগাভাগি করে মিলেমিশে বসবাস করছে।
ঐতিহাসিক বন্ধন
ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের একটি বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়, ত্রিপুরার জনগণ ইতিহাসের অন্য যে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতির তুলনায় মাথাপিছু বাংলাদেশী শরণার্থীদের তাদের বাড়িতে স্বাগত জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ত্রিপুরা সফরে গিয়েছিলেন, তাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোন বাংলাদেশী রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান ভারতের উত্তর-পূর্ব সফর করেননি। এই সফরই প্রথম ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের নতুন মাত্রা আনে।
বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকল্প
ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যমান অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে। ফেনী নদীর উপর মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন ছিল ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম যুগান্তকারী প্রকল্প। বাংলাদেশের রামগড়ের সাথে সাব্রুমের সংযোগকারী মৈত্রী সেতু জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেলে ত্রিপুরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে আবির্ভূত হবে। এই সেতুটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র ৭৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
আরেকটি প্রকল্প হল আগরতলা-আখাউড়া (বাংলাদেশ) রেলপথ সংযোগ। এই রেলপথটি ২০২৩ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যখন এটি সম্পন্ন হবে, তখন এটি বাংলাদেশের গঙ্গাসাগরকে ভারতের নিশ্চিন্তপুরের সাথে (১০.৬ কিলোমিটার) সংযুক্ত করবে এবং তারপরে নিশ্চিন্তপুরকে ভারতের আগরতলা রেলওয়ে স্টেশনের সাথে (৫.৪৬ কিলোমিটার) সংযুক্ত করবে। আগরতলা-আখাউড়া রেললাইন চালু হলে বাণিজ্য সম্পর্কের সুযোগ খুলে যাবে। শুধু তাই নয়, ভারত নিশ্চিন্তপুরে একটি সমন্বিত চেকপোস্ট এবং কার্গো হ্যান্ডলিং সুবিধা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে, যা ত্রিপুরার আগরতলা-আখাউড়া রেল সংযোগের জংশন পয়েন্ট। এই রেল সংযোগটি গুয়াহাটির পরিবর্তে ঢাকার মধ্য দিয়ে আগরতলা ও কলকাতার মধ্যে ভ্রমণের সময় কমিয়ে দেবে। আগরতলা এবং কলকাতার মধ্যে ভ্রমণের সময় বর্তমান ৩১ ঘন্টা থেকে ১০ ঘন্টা কমে যাবে কারণ এটি ১৬০০ কিলোমিটারের এর পরিবর্তে মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার ভ্রমণ করবে। ভারত ও বাংলাদেশের বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিম বাংলাদেশের মধ্যে চারটি চালু রেল যোগাযোগ রয়েছে — পেট্রাপোল-বেনাপোল, গেদে-দর্শনা, রাধিকাপুর-বিরল এবং সিংহবাদ-রোহনপুর। শেষ দুটি নেপালি ট্রানজিট ট্রাফিক ব্যবহার সম্পর্কেও অবহিত করা হয়। বর্তমান লাইনটি কেবল আগরতলা থেকে নয়, মিজোরামের লোকদেরও সাহায্য করবে, যা ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
এই দুটি সংযোগ প্রকল্পের সমাপ্তির ফলে – সাব্রুম, ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ফেনী সেতু এবং আগরতলা-আখাউড়া রেললাইনের সাথে সংযোগকারী ফেনী সেতু, ত্রিপুরা একটি ‘ভূমিবেষ্টিত’ রাজ্য থেকে একটি সুসংযুক্ত রাজ্য হিসাবে আবির্ভূত হবে। এইভাবে ত্রিপুরা ভারত, মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডকে সড়কপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করে তার সংযোগ ও সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
ত্রিপুরার মহারাজা বীর বিক্রম বিমানবন্দরটি এই বছরের মধ্যে নতুন টার্মিনাল সম্পূর্ণ হওয়ার পরে ল্যান্ডলকড উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে। এ বিমানবন্দরের কাজ শেষ হলে আগরতলা ও ঢাকার মধ্যে ফ্লাইট চলাচলের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো অন্যান্য শহরও চলাচল করবে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার্থে বাংলাদেশে নতুন বিমানবন্দরে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন। এয়ার কানেক্টিভিটি শুধু বাংলাদেশ, ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং ত্রিপুরার মধ্যেই নয়, ভারত ও আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যেও যোগাযোগ জোরদার করবে।
ভারত-বাংলাদেশের করণীয়
ত্রিপুরা বাংলাদেশের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য এবং কৌশলগত অংশীদার হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের মতো ত্রিপুরাও বাংলাদেশের জন্য ভূ-রাজনৈতিক,অনুপ্রাণিত অংশীদার। এছাড়াও ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিগত মিলরয়েছে যা অবশ্যই বাংলাদেশের সাথে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিময়কে আরও অর্থবহ করে তুলবে। ত্রিপুরা যাতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নেতৃত্ব দেয় তা নিশ্চিত করতে উভয় দেশেরই পারস্পরিক এবং স্থায়ী স্বার্থ রয়েছে। ভাষা এবং সংস্কৃতিগত মিল থাকার কারণে বাংলাদেশে বরাবরই ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গের সাহচর্যে বেশি স্বস্তি বোধ করে। পশ্চিমবঙ্গের পরে এ অবস্থানে রয়েছে আসাম। কিন্তু এখন বাংলাদেশের জন্য সময় এসেছে পূর্ব দিকে ত্রিপুরা ও মিজোরামের দিকে তাকানোর। বাংলাদেশের জন্যও ত্রিপুরা হতে পারে মিজোরাম হয়ে মিয়ানমার ও আসিয়ানের প্রবেশদ্বার।
যেহেতু ভারত বাংলাদেশ উভয় দেশেরই ভারতের এই তুরুপের তাস খেলায় পারস্পরিকভাবে লাভবান হবার সুযোগ রয়েছে, তাই ভারতের উচিত বাংলাদেশের সাথে সংশ্লিষ্ট ত্রিপুরায় বিদ্যমান যোগাযোগ উন্নয়ন প্রকল্প গুলো যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের তুরুপের তাস আরো সুসংহত করা।
লেখিকা: পিএইচডি ফেলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, রোমানিয়া।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net