বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্কের স্বার্থে ভারত কি জাতিসংঘ সনদের অবিটার ডিক্টা অনুসরণ করে তিস্তা সমস্যার সমাধান করতে পারে না?

::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

সম্প্রতি, তিস্তা থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের খাল খননের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের কাছে একটি মৌখিক পত্র পাঠিয়েছে এবং মিডিয়া রিপোর্টের তথ্য চেয়েছে। যাতে বলা হয়েছে যে ভারত তিস্তা থেকে পানি সরানোর জন্য একটি প্রকল্প শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য দুটি অতিরিক্ত খাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও, আরেকটি আন্তঃসীমান্ত নদী জলঢাকাকেও কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য খালে পরিণত করা হবে। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প ইতিমধ্যেই খালগুলির জন্য পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগকে ১০০০ একর জমি বরাদ্দ করেছে, যা জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারের ১,০০০০০ কৃষকদের সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ আন্তঃসীমান্ত তিস্তা নদীর পানি সরানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গের আরও দুটি খাল খননের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে খারাপভাবে প্রভাবিত করবে।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

 

বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ অগ্নিপরীক্ষা

হিমালয় থেকে বঙ্গোপ্সাগরে পতিত ৫৪টি নদী বাংলাদেশ এবং ভারত ভাগ করে নিয়েছে।১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ জলপ্রবাহ কনভেনশন, বার্লিন রুলস এবং হেলসিঙ্কি রুলসের মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং নিয়ম মেনে এই জাতীয় আন্তঃজাতিক বা আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির ব্যবস্থাপনা সর্বোত্তমভাবে করা হয়। কিন্তু তারপরেও দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর কাছে আন্তঃসীমান্ত নদীজনিত ইস্যুগুলো দ্বিপাক্ষিক হয়ে গেছে। এর ফলাফল স্মরূপ বেশিরভাগ সময়ই উজানের দেশগুলো স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অসম হিস্যা পায়। উদাহরণস্বরূপ, ভারত যখন খাল ও ব্যারেজ নির্মাণ করে তখন বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের ক্ষেত্রে ভারত ও চীন একই সমস্যা শেয়ার করে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভারতকে গঙ্গা ও কুশিয়ারা নদী সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করতে রাজি করাতে সফল হয়েছে। গঙ্গা নদী চুক্তি ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুশিয়ারা চুক্তি দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছিল। দশ বছর আলোচনার পরও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। তিস্তা থেকে ভারতের নির্বিচারে পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল শুষ্ক হয়ে উঠবে। এতে সবচে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হবেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষক। যদিও,  তিস্তা একটি আন্তঃসীমান্ত নদী এবং বাংলাদেশ ও ভারতের উচিত আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্য উপায়ে এর পানি বণ্টন করা। আফসোসের বিষয় যে, উচ্চ-নদীর ভারত নিজ উদ্যোগে ব্যারেজ, বাঁধ, খাল নির্মাণ করে বাংলাদেশে নদীর প্রবাহ হ্রাস করার কারণে বাংলাদেশ এমন সমতা ও যুক্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

 

সুসম্পর্কের খাতিরে জাতিসংঘ সনদের অবিটার ডিক্টা অনুসরণ

তাহলে, ভারতকে অযৌক্তিকভাবে তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার করতে পারে বলে কী ভাবিয়েছে? বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের সংঘর্ষ ঠেকানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটা করতে হলে উজান এবং ভাটি উভয়পক্ষকে অবশ্যই ন্যায় ও যুক্তি মেনে নিতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ভারত ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলপথের কনভেনশন অনুমোদন করেনি। যেখানে এই সনদের একটি মাত্র আর্টিকেলই তিস্তা সমস্যার সমাধান করতে পারে। সেটি হলো ১৯৯৭ সালের ইউএন কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেসের অনুচ্ছেদ ৭। জাতিসংঘের ওয়াটারকোর্সেস আইন বা ওয়াটারকোর্সেস কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৭(১)  অনুযায়ী, কোনো দেশ কোনো আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে অন্য কোনো দেশের ভাটা বা ভাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কনভেনশনের ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “(১) জলপথের রাজ্যগুলি, তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে, একটি ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে একটি আন্তর্জাতিক জলপথ ব্যবহার করবে৷ এবং সবশেষে, যেহেতু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতে একটি নোট মৌখিকভাবে পাঠিয়েছে একটি মিডিয়া রিপোর্টের তথ্য জানতে চেয়ে। তাতে জানতে চাওয়া হয়েছে কেনো ভারত তিস্তার পানি সরানোর জন্য একটি প্রকল্প শুরু করেছে। এক্ষেত্রে কনভেনশনের ১২ নং  অনুচ্ছেদটি জানা গুরুত্বপূর্ণ। কনভেনশনের ১২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: কোনো উজানের রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক নদীর পানি সরানোর ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যবস্থা যাতে অপর দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে নিলে তার পূর্বেই ভাটির রাষ্ট্রকে অবগত করতে হবে। এবং ভারত এক্ষেত্রে তা করেনি। কিন্তু যেহেতু ভারত চুক্তিটি অনুমোদন করেনি, তাই স্পষ্টতই ভারত এসব ধারা মানতে বাধ্য নয়। তবে এমন কিছু আছে যা ভারত এবং জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র এখনও বলেনি। ভারত অবশ্যই এই আইনের  সিদ্ধান্ত  গ্রহণকরতে বাধ্য নয় কারণ এটি এটি অনুমোদন করেনি, তবে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে এটি সমস্ত জাতিসংঘ সনদের ‘অবিটার ডিক্টা’ অনুসরণ করতে বাধ্য।

সমস্যাটি এড়িয়ে চলা হবে বোকামি

পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতের সাথে দীর্ঘদিন ধরে টানা তিস্তার পানি বণ্টন কাহিনীর একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কয়েক দশক ধরে আলোচনা এবং আমাদের ভারতীয় অংশীদারদের অসংখ্য প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি নিষ্পত্তির কাছাকাছিও নেই। এ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছে তাতে ভারত সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট করিডোর হোক বা অন্য কোনো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, ভারত সবসময়ই লাভবান। তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু এমন একটি ক্ষেত্র হতে পারে যেখানে ভারত নিঃস্বার্থভাবে বাংলাদেশকে সত্যিকারের বন্ধুত্বের প্রতিমূর্তি ধরে রাখতে পারে।

 

লেখক: সোহেল আরমান; সাবেক অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এবং পিএইচডি ফেলো, নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net