দেলোয়ার জাহিদ:
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটাপন্ন অর্থনীতিতে দেশের সমুদ্রসম্পদকে ব্যবহারের আশু পরিকল্পনা প্রনয়ণ ও সুদূরপ্রসারী একটি কৌশল গ্রহণ অবিশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সমুদ্র অর্থনীতিতে যে বিশাল সুযোগ রয়েছে, যে সুযোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারে, যে সুযোগ রয়েছে ৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের, তাকে নিয়ে এগিয়ে চলায় এ ধীরগতি দেশকে অনেক পিছিয়ে দিবে।
সরকারের বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-৪১) কিছু কৌশল ও চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরা হয়েছে এতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রতি প্রকাশ ও করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সমুদ্র অর্থনীতিতে বিনিয়োগের দ্বারকে এখনো খুলে দেয়া হয়নি। লাল ফিতায় বন্ধি হয়ে আছে সমুদ্র অর্থনীতির সব কাগুজে পরিকল্পনা। জ্ঞানের অভাব, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় উন্নয়ন কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং কার্য্যোপযোগী মানবসম্পদের অভাব এবং বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে ব্যর্থতা এখন নজরকাড়া। সমূদ্র অর্থনীতি নিয়ে দক্ষতাসম্পন্ন দেশগুলো থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে কাজ শুরু করা যেতে পারে। শুরু করা যেতে পারে দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক নানা প্রকল্প। গবেষণা ও যৌথ বিনিয়োগ সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই উন্নয়ণকে ত্বরান্বিত করবে। এ বিষয়ে ভারত, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া এবং প্রয়োজনে কানাডার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
যুগান্তরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রকাশ “সম্প্রতি এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সুনীল অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে আমরা সরকারিভাবে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত রয়েছি। যেমন, বর্তমানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু আমরা বলেছি ৫০ কোটি নয়, প্রয়োজনে ৫০০ কোটি টাকার বড় প্রকল্প নিয়ে আসেন। এই খাতে অর্থ ব্যয়ে কোনো দ্বিধা নেই সরকারের।” (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০).
চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অ-প্রাণিজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তখন সরকার জানিয়েছিল, ”১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল (বাংলাদেশের) এই এলাকায় মৎস্য আহরণ ও সমুদ্রের তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন। ফলে সমুদ্রের তলদেশে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণের নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ যাকে বলা হয় ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সমুদ্র সম্পদ নির্ভর অর্থনীতি।… জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বের প্রতিবছর ৮ কোটি ৪৪ লাখ টন সামুদ্রিক খাবার আহরণ করা হয়। বিশ্বের মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু।(সূত্র: বিবিসি)
বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির সিংহভাগ কার্যক্রম হতে পারে বেশি মাছ ও প্রাণীজ সম্পদ আহরণ, লবণ উৎপাদন, বাণিজ্যিক জাহাজ, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরনের ব্যবস্থা গ্রহণ, জ্বালানি, পর্যটন ইত্যাদি ঘিরে কর্মসংস্থানের ওপর সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির নতুন দ্বার উন্মোচন।
সমুদ্র ও এর সম্পদকে কিভাবে কতটা কাজে লাগিয়ে বিশ্বের কোন কোন দেশ কি অগ্রগতি লাভ করেছে তা এখন খুবই স্পষ্ট । যেখানে দেশে দেশে বিকল্প অর্থনীতির পথ খুঁজছে বিশ্ববাসী, যেখানে চলছে নানাহ দক্ষযজ্ঞ সেখানে পরিকল্পিত, সমন্বিত ও সতর্ক উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক সিদ্বান্তহীনতা বা ধীর গতি কেন? বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় কি শুধুই গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সুযোগ নেয়ার জন্য। আর আমাদের কর্মন্মোখ যুবকদের বিদেশ পাড়ি দিতে সাগরে আত্মাহুতি দেয়ার জন্য?
কেন সরকার একটি সমুদ্র সম্পদ মন্ত্রণালয় এখনই সৃষ্টি করছে না, কেন সরকার একটি শক্তিশালী আইনগত ক্ষমতা সম্পন্ন কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলছে না, কেন সরকার খাদ্য সংকট মোকাবেলা, কর্ম্মসংস্থান এবং প্রবৃদ্ধি বাড়ানো ও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সমুদ্র অর্থনীতিকে এক নম্বর এজেন্ডায় স্থান দিচ্ছে না তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনগণ ও বোদ্ধামহল।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী।