বাংলাদেশের চমৎকার মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন

:: সুফিয়ান সিদ্দিকী ::
প্রকাশ: ২ years ago
ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্কের এলাকার চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

রেকর্ডকৃত ইতিহাসে তুরস্কের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ২৪,৫০০ ছাড়িয়েছে। আর প্রতিবেশী সিরিয়ায় মারা গেছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ। এ নিয়ে সোমবারের ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ছাড়িয়েছে।
সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার প্রথম ভূমিকম্প আঘাত হানে। এরপর সোমবার দুপুর ও বিকেলে আরও দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এদিকে, তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা প্রেসিডেন্সি (এএফএডি) জানিয়েছে, তুরস্কের স্থানীয় সময় সোমবার বিকেলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। তুরস্ক ছাড়াও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাও ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে মৃতদেহ ও আহতদের উদ্ধার করা হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারে পৌঁছেছে। এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আহত হয় হাজার হাজার মানুষ।
স্বজনদের খোঁজে হাসপাতাল ও ধসে পড়া ভবনের সামনে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। সোমবার ভোরে যখন ভূমিকম্প হয় তখন অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন।
তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে মোট ৩১ হাজার মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় ৮০,০০০ আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর ভূমিকম্পের কারণে ১০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসতি স্থাপন করেছে।
তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে বলেছেন, “সরকারের মূল লক্ষ্য আগামী এক বছরের মধ্যে এই গৃহহীনদের জন্য স্থায়ী আবাসন প্রদান করা।” যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভূমিকম্পের আঘাত ভুলে যেতে পারে।’
জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস বলেছেন, দুই দেশে মোট মৃতের সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি হবে।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় জরুরি ত্রাণের জন্য প্রায় ৮৯০ মিলিয়ন রুপি (৮.৫ মিলিয়ন ডলার) প্রাথমিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ায় দ্রুত সাহায্য পাঠায়।
এ ছাড়া রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইউক্রেন, জার্মানি, গ্রিস, ইসরাইল, ইরান, জাপান, নরওয়ে, স্পেনের মতো দেশও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও তুরস্কের প্রতি তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কাতার তুরস্কে ১০ হাজার মোবাইল বাড়ি পাঠাচ্ছে। কাতার একটি ফিল্ড হাসপাতালের সরঞ্জাম এবং মানবিক সহায়তাও পাঠাচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চেয়েছেন কারণ দেশটি জোড়া ভূমিকম্প এবং বহু আফটারশক দ্বারা আঘাত করা বিশাল চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে লড়াই করছে।
তিনি বলেন, তারা নগদ সহায়তা পেতে আগ্রহী নন তবে শীতবস্ত্র, ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ বাংলাদেশ থেকে পছন্দ করা হচ্ছে।
দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রদূত ভূমিকম্পের পর তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আরও জীবন বাঁচাতে আগামী এক বা দুই দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্যদের সমন্বয়ে ৪৬ জন বিশেষজ্ঞের বাংলাদেশী অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দলের কথা উল্লেখ করে তুর্কি কূটনীতিক বলেন, দলটি গাজিয়ানটেপে কাজ করবে যেখানে এখনও ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছে।
বৃহস্পতিবারকে “তুর্কিয়ে ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য শোক দিবস” হিসেবে ঘোষণা করার জন্য বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন: “আমরা এই সংহতির কাজটি কখনই ভুলব না।”
তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করতে বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছে। বুধবার এ সংক্রান্ত গেজেট জারি করেছে সরকার। গেজেট অনুযায়ী, দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্কে উদ্ধারকাজে অংশ নিতে বাংলাদেশ থেকে একটি উদ্ধারকারী দল গেছে। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের পাঁচজন করে সদস্য থাকবে।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এমন বিপদের দিনে বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের জনগণ তাদের পাশে আছে।
সোমবার এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও পৃথক বাণীতে শোক প্রকাশ করেন।
সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধ, সোয়েটার, শুকনো কেক, বিস্কুট, কম্বল, তাঁবুসহ ১১ টন পণ্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ৪২৮ প্যাকেট শুকনো কেক (১১১০ কেজি), ৩৪৭ প্যাকেট ডাইজেস্টিভ বিস্কুট (৫৫৬ কেজি), ২৩ প্যাকেট কম্বল (১৩৮০ কেজি), ১০২ প্যাকেট ট্যাবু (৪৪২৩ কেজি), ৪৪ প্যাকেট ওষুধ (৯৮০ কেজি) এবং ১৭০ প্যাকেট সোয়েটার (১৩০০ কেজি) আছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। শুধু তুরস্কেই এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার ৬৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে, সিরিয়ায় অন্তত ৩,৩৭৭ জন মারা গেছে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধারে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা।
সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে বাংলাদেশের একটি উদ্ধারকারী দলও সেখানে তুরস্কে কাজ করছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে তারা ইতিমধ্যে একটি কিশোরীকে জীবিত ও বেশ কয়েকটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে।
বাংলাদেশের অনেকের মনে দারিদ্র্য, বঞ্চনা এবং দুর্নীতির একটি চিত্র দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে যে এই নেতিবাচক চিত্রটি প্রকৃতপক্ষে ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির পাশাপাশি অন্যান্য দেশে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মানবিক কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা করে, প্রায়শই যখন অন্যান্য আরও সমৃদ্ধ এবং সম্পদ-সজ্জিত দেশগুলি তা করেনি। সময়ের মানবিক প্রয়োজনে উঠে এসেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানবিক সহায়তার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় শুকনো খাবার, কম্বল, তাঁবু এবং ওষুধের আকারে বিপুল পরিমাণ জরুরি ত্রাণ সরবরাহ করা প্রশংসনীয়। . বাংলাদেশের সময়োপযোগী মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি খাদ্য, আশ্রয় এবং সামাজিক পরিষেবার তীব্র ঘাটতি এড়াতে, সিরিয়া ও তুরস্কের মৌলিক আর্থ-সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করতে এবং দেশ পুনর্গঠনে কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারে।
এটি আঞ্চলিক ভ্রাতৃত্ব, মানবিকতা, দক্ষিণ এশিয়া, মুসলিম বিশ্বের সমন্বিত উন্নয়ন এবং কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক প্রান্তিককরণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সহযোগিতার নীতির প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকারের প্রমাণ।
বাংলাদেশ, এখন দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হওয়া সুদানের কাছেও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। ওগঋ-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে, বাংলাদেশ সুদানের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ১৫ জুন ২০২২-এ টঝ$৬৫০ মিলিয়নের ‘ঋণ মওকুফ’ মঞ্জুর করেছে। এর আগে, বাংলাদেশ সোমালিয়াকেও অনুরূপ সুবিধা দিয়েছিল (৮.২ কোটি টাকা প্রদান; প্রায় ৮.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।) একটি ওগঋ উদ্যোগের অংশ হিসাবে তার দারিদ্র্যের শেকল ভাঙতে।
এই সমস্ত মানবিক কর্মের ক্রমবর্ধমান উদ্দেশ্য কী? বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের সাথে গভীর একীকরণের দিকে নজর দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী তার ভাবমূর্তি গড়ে তুলে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে ব্র্যান্ডিং করছে। দেশটির ক্রমাগত মানবিক সহায়তার কার্যক্রম এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং বিশ্বব্যাপী সংকটে জনগণকে সহায়তা করার সক্রিয় প্রচেষ্টা দেশটিকে মানবিকতার প্রতীকে পরিণত করেছে। অনেক ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি চমৎকার মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একটি দাতা দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, দেশটির অনুদানের ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত হবে বলে আশা করা হচ্ছে বিশ্বকে মানবিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। যদিও প্রয়োজনীয় তহবিলের তুলনায় বাংলাদেশের ত্রাণ সরবরাহের পরিমাণ কম, তবে তাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের উদাহরণ অনুসরণ করে, বিশ্বকে আফগানিস্তানের সাথে কাজ করতে হবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনাহারে ও ক্ষুধায় মারা যাওয়া থেকে বাঁচাতে।

লেখক: সহকারি গবেষক, সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (সিএফআইএসএস)।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net