বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিশীলতায় রূপান্তর আনবে মাতারবাড়ি গভীর-সমুদ্র বন্দর

:: ড. সাবেরা চৌধুরী ::
প্রকাশ: ২ years ago

গত কয়েক দশকে দেশে লক্ষণীয় অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া বা ভারতের মতো বাংলাদেশেও একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাব অনুভূত হয়েছে। অবশেষে গভীর সমুদ্র বন্দরের দীর্ঘদিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার ৫২ বছর পর ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির ক্রমবর্ধমান পরিমাণ পরিচালনা করতে এবং দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের উপর চাপ কমাতে  জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর অর্থায়নে বাংলাদেশ কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে মাতারবাড়ী শীঘ্রই গুরুত্বের দিক থেকে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের অন্যান্য আমদানি-রপ্তানির হাবকে ছাড়িয়ে যাবে।

কোভিড মহামারী শেষ হওয়ার সাথে সাথে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, একটি এলএনজি টার্মিনাল এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার নির্মিত হবে । প্রথম পর্যায়ে ১ মিলিয়ন বিশ-ফুট সমতুল্য ইউনিট (TEUs) পরিচালন ক্ষমতাকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগেই ২৫ এপ্রিল মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গভীর সমুদ্রের জেটিতে ডক করেছিল ২২৮ মিটার দৈর্ঘ্যের পানামার জাহাজ “আউসু মারো”। এটি দেশের যে কোনো বন্দরে নোঙ্গর করা সবচেয়ে বড় জাহাজের।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

মাতারবাড়ি গভীর-সমুদ্র বন্দর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করা, বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা করার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল এবং ভুটানের পাশাপাশি আশেপাশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বিস্তৃত করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।

এই বন্দরটি একটি উল্লেখযোগ্য ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে কাজ করবে যা বাংলাদেশের সাথে আঞ্চলিক  অন্যান্য দেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করবে, বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে বাড়িয়ে তুলবে। জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০২০ সালে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে একটি শিল্প কেন্দ্রের ধারণার প্রস্তাব করেছিলেন। বঙ্গোপসাগর অঞ্চল একটি শিল্প কেন্দ্র গড়ে তুলতে সে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সম্প্রতি ১.২৭ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে এবং  লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের হতে সাহায্য করবে।

বঙ্গোপসাগরের উত্তরে বদ্বীপ অঞ্চলে কৃষি ও খনিজ সম্পদের একটি উর্বর ভূমি রয়েছে যা এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চল বঙ্গোপসাগরে একটি শিল্প পাওয়ার হাউসে উদীয়মান এশিয়ার দেশগুলো বিনিয়োগ করে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভবনাকে উন্মোচিত করা যাবে। গভীর-সমুদ্র বন্দরের সাথে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ভবিষ্যতে পূর্ব-এশীয় অঞ্চলের মতো এ অঞ্চলে একটি শিল্প প্রবৃদ্ধি বেল্ট তৈরি করতে পারে। বেসরকারী পুঁজি, বহুজাতিক কর্পোরেশন এবং মোবাইল শিল্পকে এ এলাকায় প্রলুব্ধ করে অবকাঠামো বিনিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ শক্তিশালী হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইউরোপে কোনো পণ্য পাঠানো হয় না। কার্গো কন্টেইনারগুলি প্রথমে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং কলম্বোর বন্দরে নেয়া হয়। পরে, এটি একটি বড় জাহাজে করে (মাদার ভেসেল) ইউরোপের পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করছতে হয়। ফলে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠে। গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শেষ হলে রপ্তানি পণ্য সরাসরি মাতারবাড়ি থেকে ইউরোপ বা আমেরিকার যেকোনো বন্দরে যেতে পারবে। ফলে ব্যবসা করার খরচ কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে, বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য শিপিং করতে ৪৫ দিন সময় লাগে। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে সেখানে পণ্য  যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৩ দিন।

গভীর সমুদ্র বন্দর মাতারবাড়ী ও অন্যান্য বন্দরের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত সামুদ্রিক দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল; পায়রা বন্দর ও মংলা বন্দর থেকে মাতারবাড়ির দূরত্ব যথাক্রমে ১৯০ ও ২৪০ নটিক্যাল মাইল। ফলে মাতারবাড়িতে মাদার ভেসেল (একটি বিশাল কন্টেইনার জাহাজ) থেকে পণ্য খালাসের পর দ্রুত সড়ক ও সমুদ্রপথে অন্যান্য বন্দরে নিয়ে যাওয়া যাবে। মাতারবাড়ী বন্দর পুরোপুরি চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। জাইকার মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায়, মাতারবাড়ি টার্মিনাল সমুদ্রপথে সরবরাহ করা প্রতিটি ২০ ফুট লম্বা কন্টেইনারে ১৩১ ডলার ও একটি ৪০-ফুট কন্টেইনার প্রায় ১৯৭ ডলার সাশ্রয় করবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গভীর সমুদ্র বন্দর দেশের অর্থনীতিকে ২-৩ শতাংশ বৃদ্ধি করবে।

চট্টগ্রাম উপকূলের এই গভীর সমুদ্র বন্দর শুধু বাংলাদেশ নয়, বঙ্গোপসাগর এলাকার সকল দেশের অর্থনীতির জন্যই হতে পারে গেম চেঞ্জার। বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর সমগ্র অঞ্চল এবং এর পশ্চাৎভূমি, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল এবং ভুটান, সেইসাথে ভারতের বাকি অংশও যৌথ ব্যবসা, শিল্প ও বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে উপকৃত হবে। মাতারবাড়ী গভীর-সমুদ্র বন্দর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত কিছু সম্ভাব্য সুযোগ তৈরি করেছে: ক) গভীর-সমুদ্র বন্দরটি আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনে হওয়ায় আশেপাশের দেশগুলির সাথে শিল্প ব্যবসার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এন্ট্রি পয়েন্টে পরিণত হবে। এটি আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করবে। খ) প্রকল্পকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে, যার ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান এবং আয় হবে। গ) বন্দরটি আন্তর্জাতিক অংশীদারদের বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ব্যবসার জন্য প্রবেশকে সহজ করে তুলবে। ঘ) বন্দর প্রকল্পের জন্য রাস্তা, রেল এবং নদী নেটওয়ার্ক সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, আন্তঃ-আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াবে এবং দ্রুত অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের দিকে মোড় নিবে।

এটি সত্য যে, আসিয়ান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্য খুব বেশি একীকরণ হয় নি। এমনকি বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কেও কিছু কিছু বাধা রয়েছে যা এই দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর বাণিজ্য একীকরণ থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হতে বাধা দিচ্ছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার অভাবে একে অপরের বাজারে সহজে ভৌত প্রবেশাধিকারের দ্বারা প্রদত্ত ভৌগলিক সুবিধা এবং বাণিজ্যের কম ট্রানজিট খরচ সম্পূর্ণরূপে লাভ করা যায়নি। মাতারবাড়ি কেন্দ্রিক বাণিজ্য এবং অবকাঠামো বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি পরিবর্তন হবে।

ভারত ও বাংলাদেশের এমন কিছু এলাকা রয়েছে যেগুলি প্রাথমিকভাবে ভূমিবেষ্টিত, ব্যাপকভাবে কৃষিপ্রধান, দারিদ্র্যের গড় হার অন্য জায়গার চেয়ে বেশি। যদিও সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা এতে ভূমিকা পালন করে, তবে গবেষণায় এটিও উঠে এসেছে যে, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলির দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলোঃ দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্র থেকে অঞ্চলটির ভৌগলিক দূরত্ব এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি।

অবকাঠামোর অভাব বা খণ্ডিত অবকাঠামো, বাণিজ্য বিধিনিষেধ এবং সীমান্ত জুড়ে বাধার কারনে কিছু কিছু অঞ্চল প্রায়শই প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেমন, উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্য তাদের সংযোগগত দূরত্ব, উচ্চ পরিবহন খরচ এবং সীমাবদ্ধ ট্রানজিট বিকল্পের কারণে ভারতের অর্থনৈতিক কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ। কারণ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রভাব আগামী বছরগুলিতে অর্থপূর্ণ উপায়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলিতে ট্রানজিট প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত নয়, নেপাল, ভুটান এবং বঙ্গোপসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করতে পারে যা স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে একটি গেম চেঞ্জারের ভূমিকা রাখবে।

লেখক: ড. সাবেরা চৌধুরী; সিনিয়র গবেষক, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net