ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন:
মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে একটা দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পরিণত করছে। পাঁচ বছরের ও বেশী সময় ধরে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে এবং প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানবপাচার, মাদক চোরাচালান ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর চাপ ফেলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা এই উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
মিয়ানমারের চলমান সংকটে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে আসিয়ান ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে। এর প্রেক্ষিতে সামরিক সরকার মিয়ানমারে শান্তি ফেরাতে সময়সীমা নির্ধারণের জন্য যে কোন ধরনের চাপ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে বলে আসিয়ানকে সতর্ক করেছে এবং চলমান সহিংসতার জন্য দেশটির সশস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধাদের আন্দোলনকে দায়ী করেছে। আসিয়ান পাঁচ-দফা ঐকমতের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল যা চলমান রয়েছে।পাঁচ দফা পরিকল্পনায় অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ, সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে সংলাপ, আসিয়ানের একজন বিশেষ দূতের মধ্যস্থতা, মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে দেখা করার জন্য বিশেষ দূতের মিয়ানমার সফর রয়েছে।মিয়ানমার সরকার প্রাথমিকভাবে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল কিন্তু মানবিক সাহায্য চাওয়া এবং আসিয়ানের দূতকে পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া ছাড়া পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য তেমন কিছু করেনি।
মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীনা রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছে যে চলমান সংঘাত থামার পর অনুকূল পরিস্থিতিতে তাঁরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। চীন মনে করে যে, এই সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করতে হবে কারণ প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা ইস্যুর একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান। পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে। মিয়ানমার চীনের মধ্যস্থতায় প্রত্যাবাসন শুরু করবে বলে জানিয়েছে তবে কবে নাগাদ এই প্রক্রিয়া শুরু হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলেনি চীন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু, বুথিডঙ এবং রাথেডঙ অঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এ এ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কারনে সেখানকার রোহিঙ্গারা চরম সংকটে আছে। রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাইলেও তাদেরকে লক্ষ্য করে আতঙ্ক ছড়ানো হয় এবং চলমান সংঘর্ষকালে তাদের উপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ এ থেকে দূরে থাকার জন্য জান্তারা রোহিঙ্গাদের উপর চাপ প্রয়োগ করার পাশাপাশি জান্তা সেনারা এ এ’র সঙ্গে যোগসাজশ আছে সন্দেহে রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার করে মুক্তিপণও দাবি করে। বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ২৪টি ক্যাম্পে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে অমানবিক অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে। জীবিকা, চলাচল, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যাপ্ত খাদ্য ও আশ্রয়ের গুরুতর সীমাবদ্ধতা এবং নূন্যতম মানবিক সহায়তার অনুপস্থিতিতে তাঁরা অসহনীয় জীবনযাপন করছে। ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা তাদের গ্রামে ও বাড়িঘরে ফিরে যেতে চাইলে কর্তৃপক্ষ গ্রামগুলো তাদের জন্য নিরাপদ নয় বলে জানায়। মিয়ানমারের সামরিক সরকার এ এ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মাঝে চলতে থাকা সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যের ছয়টি শহরে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। জাতিসংঘ ও এর অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলো মিয়ানমারে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছে না। ত্রান কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ সাল থেকে ধ্বংস হওয়া বা দখল করা রোহিঙ্গা গ্রামের মালিকানা দেশটির সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা শুরু করেছে। ২০১৭ সালের নির্যাতনের পরে যেসব রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ী ও জায়গা জমি ছেড়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গেছে, এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হলে তাদের আর সেই সম্পত্তির মালিকানা থাকবে না। জান্তা সরকার এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে আসলেও তাঁরা তাদের নিজ বাড়ীতে বা গ্রামে ফিরে যেতে পারবে না এবং তাঁরা বন্দী শিবিরে থাকতে বাধ্য হবে। পদক্ষেপটি মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের চিহ্ন মুছে ফেলার একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে তাদের বাসভূমি খুঁজে পাবে না ও তাদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। অবিলম্বে এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সামগ্রিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ চলছে। জাতীয় ঐক্যের সরকার (এন ইউ জি) জনগণের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের আহ্বান জানানোর পর থেকে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। এই অবনতিশীল পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ এ’র কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ওয়াং ম্রা নাইং জানায় যে তারা রোহিঙ্গাদের ‘রাখাইনের মুসলমান অধিবাসী’ এবং রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করে। রোহিঙ্গা সংকট তাঁদের জন্য একটা বড় ইস্যু, এ এ চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সাথে আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এন ইউ জি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য রাখাইন অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের জায়গা স্পষ্ট। দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে।
আগস্ট ২০২২ থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির কারণে সীমান্তে অস্থিরতা চলছে। সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যে আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং ৩০ অক্টোবর টেকনাফে বিজিবির সঙ্গে পতাকা বৈঠকে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)ভবিষ্যতে এমন ঘটনা না ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ে বিজিবি-বিজিপি একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে এবং অনুপ্রবেশ রোধ, মাদক চোরাচালান বন্ধ করতে কাজ করাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একত্রে কাজ করতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপিত হলে তা সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
গত অক্টোবর মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফোঁ মিয়াতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেছে। সেনাপ্রধান দুই দেশের সেনাবাহিনীর সম্পর্ক উন্নয়ন, উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বিষয়–সংক্রান্ত যৌথ আলোচনা, প্রশিক্ষণ বিনিময়, সম্মিলিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রাসঙ্গিক তথ্য বিনিময়সহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানায়। সেনাপ্রধান বলেন, বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকেরা একটি আঞ্চলিক সমস্যা। দীর্ঘদিন তাঁদের স্থান দেওয়ার ফলে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকিসমূহ দুর করার লক্ষ্যে তিনি দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। মিয়ানমারের প্রতিনিধিরাও সীমান্ত এলাকায় শান্তিরক্ষার জন্য উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একসাথে কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে উভয় সেনাবাহিনীর সম্পর্ক আরও সূদৃঢ় হবে এবং দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ আরো সহজ হবে বলে আশা করা যায়।
প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার বাস্তবসম্মত ও স্থায়ী সমাধান। এর বাস্তবায়নের শুরুতে মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে হবে এবং আসিয়ান এব্যাপারে তাদের দৃঢ় অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছে। চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাজ করছে এবং মিয়ানমারে শান্তি ফিরে আসলে প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। মিয়ানমারে ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। চলমান সহিংসতায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলো মিয়ানমারে ত্রান কার্যক্রম চালাতে পারছে না বিধায় রোহিঙ্গারা সেখানে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে।এই ত্রান কার্যক্রম অবিলম্বে চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বাড়িঘর ও জায়গা জমি অন্য কারো কাছে হস্তান্তর বন্ধ করতে হবে।গত অক্টোবর মাসে বিজিবি – বিজিপি বৈঠক এবং মিয়ানমারের সেনাপ্রতিনিধিদের বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাৎ একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং এই উদ্যোগ একটা আস্থার জায়গা সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায় যা চলমান রাখতে হবে। এন ইউ জি ও এ এ মিলিতভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ভুমিকা রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। সম্মিলিতভাবে এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি মিয়ানমারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তাদের আগের বাড়িঘর ও গ্রামগুলোতে পুনর্বাসন করা শুরু হলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে ও রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যাবে এবং এর ফলে সার্বিক প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক এটাই কাম্য।
লেখক: ব্রি. জেনারেল (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল,
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।