সুমধুর বাঁশির সুরে রাখালের মননের বেদনা কিংবা প্রেয়সীর রূপ-লাবণ্যের নিবেদনে সুরাপিত প্রতিটা তানে গ্রাম বাংলার চিরাচরিত রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। খরতাপ গ্রীষ্মের দুপুরে বৃক্ষরাজির ছায়াতলে আশ্রিত হয়ে রাখালের বাঁশিতে মধুরতার আবেশন ঘটে।
বাঙালি মননে বাংলাদেশের যে রূপ আঁকা আছে তাতে সন্দেহাতীত ভাবেই গ্রামের রূপবৈচিত্রে আঁকা সুজলা,সুফলা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক আবহের বিরাজমান চিত্র। রাখালের খেলাগৃহ, দুরন্ত কিশোরের নদীতে ঝাপিয়ে পড়ার দৃশ্য সহজাত। ঋতুভেদে নানান ঢঙে সাজানো অপরূপ সৌন্দর্য্যের মায়াবতী দেশটিই আমাদের বাংলাদেশ।
মাটির স্নিগ্ধ গন্ধে কৃষকের বদন নতুনের আহ্বানের গীত রচায়, কৃষক বধুর ব্যস্ত সকালে মাঝে সাঝে কোকিলের কুহুতানে মুগ্ধতা ছড়ায়। বাংলাদেশ কল্পনায় এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্য বাদ দেওয়ার দুঃসাহস করছি না, করছিনা এমন দৃশ্যপট মুছে যাওয়ার মতো অশুভ চিন্তা। তবে, প্রসঙ্গ যখন প্রকৃতি ও মানুষ, তখন বিরস চিন্তনে যদি কসুর করে বসি তখন বিনীতচিত্তে ক্ষমা করবেন।উপরের নির্ণীত চিত্রপটে আমার বাংলার যে রূপের প্রকাশ পেয়েছে তা সত্যিকার রসিকজনের মননে প্রেমানুভূতি জাগাবে, কবিতায়, গল্পে চয়িত হবে নানান ঢঙের বন্দনা।
তবে, আজ যে প্রকৃতি ও মানুষের জন্য আয়োজন সাজাতে বসেছি তারা অসুস্থ!
অসুস্থ শব্দটি শুনতেই কেমন জানি লাগছে, স্বাভাবিক ভাবে আমরা তেমন একটা বলতে চাই না, আমি অসুস্থ! শত ব্যথা বুকে চেপে ধরে বলেই বসি আমি ভালো আছি! কিন্তু-এই মিথ্যাচারে লাভ কি? কি কারণে এমন মিথ্যাচার? নিজেরাও জানিনা এর শেষ কোথায়।
কিন্তু আজ নিয়ত করে বসেছি অসুস্থতার গল্প বলবো বলে, প্রকৃতির কথা দিয়েই শুরু করছি- যার রূপ কীর্তনে কবিদের কত শত রকমের শব্দযোগ সেই প্রকৃতির অসুস্থতার খবরে না জানি কারো মনে চিন্তার উদ্বেগ ঘটে কিনা, ঘটলে ভালো, না তে তেমন একটা ক্ষতি নেই সহ্য করার ক্ষমতা রপ্ত করেছি বহুদিন আগেই।
প্রকৃতি তার অসুস্থতা নিজে থেকে বাঁধিয়েছে তেমন নয় মানুষেরা প্রকৃতিকে অসুস্থ হওয়ার উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে। প্রকৃতি তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে, বহমান নদীর বুক ছিঁড়ে বেরসিক কত স্থাপনা, বৃক্ষ কেটে কত স্থান জুড়ে তৈরি হচ্ছে নানান ঢঙের, নানান রঙের পর্যটন কেন্দ্র!
যত্রতত্র ময়লা আর্বজনা ফেলে প্রকৃতির দেহে বাঁধিয়েছে ক্যান্সারের মতো রোগজনিত সমস্যা। বিচারবুদ্ধির তোয়াক্কা না করেই নষ্ট করা হচ্ছে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনে আপাতদৃষ্টিতে লাভ মনে হলেও আসলেই নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করছি, আজ যেদিকে তাকাই না কেনো কোনো না কোনো ভাবে দেখতে পাই মনোরম পরিবেশটা বিষিয়ে আছে নানা রকমের বর্জ্যে।
আগুনে ছোট ছোট গাছ পুড়িয়ে সৃজন করে জুমের চারাগাছ কিন্তু সভ্য সমাজের মানুষেরা আগুনে পুড়িয়ে বৃক্ষরাজি সৃজন করছে প্রকৃতি ধ্বংসের নানা স্থাপনা।
আগেরকার দিনের রাস্তার চারপাশে নানা ধরণের বৃক্ষের সমারোহ দেখতে পেতাম বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারতাম কিন্তু ময়লা ও অসুস্থ প্রকৃতিতে নিশ্বাস নেওয়াতেও কষ্ট হচ্ছে। নদী নালায় মাছ প্লাস্টিক খাচ্ছে, ক্ষতিকর কেমিক্যালে প্রকৃতির বুকে অসুস্থতার বীজ বুনে রেখেছে তবে সে বীজ অংকুরিত হচ্ছে শুধু মাত্র প্রকৃতির দেহে এমন কিন্তু নয় মানুষেরাও কোনো না কোনো ভাবে সে অসুস্থতায় গ্রাস হচ্ছে। মোদ্দা কথায় আসি, এই অসুস্থ প্রকৃতি যেমন আমাদের জনজীবনে নানা হুমকির কারণ হচ্ছে তেমনি আমরাও ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতিকে। প্রকৃতি একাই নিজেকে বিষিয়ে তুলেনি, অসুস্থ দেহের কাতরতা ঠিকই বলতে চাচ্ছে আমরা বুঝতে পারছিনা।
মানুষের গল্প- অসুস্থ মানুষ! হাসপাতালে চিকিৎসার উপায় না বলে এখানে প্রকৃতির সাথে কেনো মিলিয়ে উপস্থাপন তা বলতে বসেছি,
আগে বলে রাখা ভালো এই অসুস্থতা হাসপাতালে চিকিৎসার নয় এই অসুস্থতার লাঘব ঘটবে একমাত্র বিচারবুদ্ধিতায়, নৈতিকতা চর্চার মাধ্যমে।
তাই মানুষের অসুস্থতার দিকগুলো আগে বলছি, আমরা জানি বিচারবোধে মানুষের অন্যান্য প্রাণিদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের আসরে আরোহন করে আছে, বিচার ও বুদ্ধির মারপ্যাঁচে অসম্ভবকে করেছে সম্ভবপর- অতঃপর নিজেরা নিজেদের লোভে বশবতী হয়ে অসুস্থ করেছে নিজের বিবেকবোধকে, আমরা আজ জানবো মানুষের অসুস্থ হয়ে উঠার গল্প –
লোভ ও মুনাফালোভী:
তুচ্ছ জীবনকে সাজাতে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ হিসেবে উপস্থিত হয় ”ভালো থাকার আয়োজন ” এই ভালো থাকতে গিয়ে মানুষ জড়িয়ে পড়ছে নানা অসুস্থ চিন্তার কাজে- লোভে বশবতী হয়ে খুন, গুম, মিথ্যা মামলা অন্যের জমি দখল করা, ছিনতাইসহ নানান খারাপ কাজ। আর মুনাফালোভী মানুষেরা, মানুষের দুবর্লতার সুযোগ নিয়ে জিনিসপত্র জমিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে বিক্রি করছে।
সহজে বিখ্যাত হওয়ার অপচেষ্টা:
অপসংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে যেভাবে আমরা বিষিয়ে দিচ্ছি আমাদের সুস্থ বিনোদন মাধ্যমকে, তেমনি সস্তা ও সহজে বিখ্যাত হওয়ার নেশায় আমরা কি করছিনা বর্তমানে, টিকটক, লাইকি, ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে নীতিবিরুদ্ধ কাজ করে ছড়িয়ে দিচ্ছি সর্বস্তরের মানুষের কাছে।
শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করে:
মানুষ শিক্ষা অর্জনের আশায় গমন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিন্তু আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, শিক্ষা ছাড়া সকল কিছু চাইলে আপনি সেইসব কথিত প্রতিষ্ঠান থেকে পাবেন।
হাসপাতালে ডাকাতিপণা:
অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, কিন্তু সেই হাসপাতালে বসে আছি কতিপয় নানা শ্রেণির অসুস্থ মানুষ। যারা পরীক্ষা বাণিজ্য, প্রবেশ বাণিজ্য, সিট বাণিজ্যের মতো নিন্দনীয় কাজ গুলো করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এমন শত শত দিক উপস্থাপন করলেও বোধহয় মানুষের অসুস্থতার দিকগুলো তুলে ধরা সম্ভবপর হবে না। মানুষ জাগতিক মোহে আবিষ্ট হয়ে জড়িয়ে পড়ছে এমন শত শত অসুস্থ কাজে, বিবেক শূন্য মানুষের কর্মের দ্বারাই নষ্ট হচ্ছে আমাদের মতো ছোট দেশের আগামীর সম্ভাবনা।
তাই, পরিশেষে বলতে চাই – আমরা কেউ এমন অসুস্থতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই না, চাই সুন্দর ও সুস্থ জীবনধারা। তাই সবিনয়ে বলছি আমরা চাইলেই পারবো প্রকৃতি ও আমাদের নিজেদের সুস্থ করে তুলতে। সুস্থ শরীর-মন ও প্রকৃতি পেতে আমাদের অল্প কিছু কাজ করলেই হবে। যেমন: দায়িত্ববোধের চর্চা, নীতি ও নৈতিকতার চর্চা করা, লোভ ও স্বার্থপরতার মূলোৎপাটন, প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতন থাকতে দেওয়া, সুবুদ্ধির চর্চা।
তবেই আমরা চিৎকারে বলতে পারবো আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, বিচারবুদ্ধিতে আমাদের সমক্ষ কেউ নেই, প্রকৃতির নির্মল বাতাসে আবারো ভেসে আসবে কোনো রাখালের মধুর বাঁশির সুর।
লেখক: আহমেদ হানিফ; শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।