পাণ্ডিত্যের জাহিরে জ্ঞানের দীনতা

:: আহমেদ হানিফ ::
প্রকাশ: ২ years ago

শহরটা ছেয়ে গেছে নানান রঙের ব্যানার, পোস্টারে। প্রতিটা গলিতে গলিতে আঁকা দেওয়ালিকা কিংবা মাইকের জোড়ালো শব্দে প্রচার চলছে নানান ঢঙে ‘আসুন, সফল মানুষ হতে এখানে! আমরা দিচ্ছি সেরাদের সেরা হওয়ার মন্ত্রণা’ লিফলেটে জ্ঞান বিতরণ চলছে হরেক রকম উৎসব উপলক্ষ্যে।

কাগজের বুকে নীতি কথার গল্প বলে বেড়ালেই কিংবা চমকপ্রদ অফারে জ্ঞান বিতরণের সুযোগ দিলেই কি আমাদের রুচির, চিন্তার পরিবর্তন হবে?

ধরুন মশায় আপনি বিরুদ্ধাচরণে বললেন সফল মানুষের কথা না জানলে অনুপ্রেরণা পাবেন কোথায় থেকে? কে দিবে আপনাকে জীবন ঘনিষ্ঠ কথাদের সমারোহ সাজিয়ে? আচ্ছা, কসুরগুলো নিজের মাথায় নিয়ে বলছি, সফলতার গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে কতক মানুষকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন নাতো?

মেধাবী ছাত্রটির লাশে পরিণত হওয়ার কারণ জানেন?

কুমিল্লার এসএসসি ফেল শিক্ষার্থীটির সুইসাইড নোটের শেষ আহাজারিগুলো মননে কি নাড়া দেয়নি?

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

নিশ্চয় আপনার চেতনায় আঘাত করেছে, আপনি এমন অপমৃত্যু কামনা করেন নি, আমি জানি খবর গুলো আপনার বিবেককে প্রশ্ন করতো কেন এমন তাজা প্রাণ গুলো ঝড়ে যাচ্ছে নিমিষেই।

আমি নিজেকে শেষ করে দেওয়া দলের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাচ্ছি না, সফলতার গল্প বলার মানুষের বিরুদ্ধাচরণ কিংবা নগরের মোড় গুলোর জ্ঞান বিতরণ প্রতিষ্ঠানেরও বিরুদ্ধাচারণ করছি না।

তাহলে আমি কি বলতে চাচ্ছি, আমি বলতে চাচ্ছি পাণ্ডিত্য জাহির করা একদল মানুষের জন্য কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের সুন্দর আগামীর, সোনার মানুষ হবে যারা তাদের পক্ষ নিয়ে কিছু কথা বলবো।

আত্মহত্যার দিকে ধাবিতকরণ:
আমার পাশের বাসার একটা ছেলের গল্প দিয়েই শুরু করছি ছেলেটা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলো কিন্তু দুঃখের বিষয় সে এক বিষয়ে কৃতকার্য হতে পারেনি, সবাই তাকে স্বান্তনা দিচ্ছে আরে এটা কোনো বিষয় না, মানুষের জীবনে এমন কত ঘটনার মধ্যে অতিবাহিত হতে হয় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে পড়ে থাকলে জীবনে চলা যায় নাকি।ছেলেটা বুঝলো তার কষ্টে সবাই তাকে সাপোর্ট দিচ্ছে সে নিজেকে গুছানোর সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুতির শপথ নিলো।
বেশ ভালো কথা ছেলেটা মেনে নিলো নিয়তির বিষয় সব ঠিকঠাক চলার কথায় তো!
এই বিষয়টা এখানে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটা থাকেনি, শুরু হয়ে গেলো নিজের পাণ্ডিত্যের গল্প শুনানো মানুষের অত্যাচার মুঠোফোনে খানিক পর পর কল আসতে লাগলো আর গদগদ হয়ে বলতে লাগলে আসি এ+ পেয়েছি, তোমার রেজাল্ট কি?
ছেলেটার ফোন সহসা বন্ধ হলো কিন্তু পাণ্ডিত্য জাহির করা মানুষের অত্যাচার আর থামে না,ছেলেটার মায়ের ফোনে বারবার কল আসতে লাগলো আর সেই একই কথা আমার রেজাল্ট এই তার কি অবস্থা?
আত্মীয়রা বাদ যায়নি তারাও লেগে পড়লো জ্ঞান বিতরণ ও সফলতার গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে।
এমন নানামুখী আক্রমণে মায়ের কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেলো, অসুস্থ বাবার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
নতুন জীবনের গল্প বুনার শপথ করা ছেলেটা তখন নিজেকে আর সামাল দিতে পারছিলো না বারবার নিজের মৃত্যু কামনা করছিলো হয়তো সুযোগ খুজতে লাগলো একটা একাকিত্ব রাতের যেখানে হারিয়ে যাবে, মুছে দিবে নিজের ব্যর্থতার গল্প।
যেমনটা আমরা কুমিল্লার ছেলেটার মাধ্যমে জানতে পেরেছি সফলতার গল্প কিংবা চারদিক থেকে আসা কথার জেরে মায়ের গায়ে বাবার হাত দেওয়া তার পৃথিবী থেকে বিদায়ের উপলক্ষ্য করে দিয়েছে।
তাই বলতে পারি এমন বহু সফলতার অতিমাত্রায় প্রচারের কারণে অনেকেই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

সৃজনশীল সত্তার করুণ মৃত্যু:
ক্যানভাস আর রংতুলিতে স্বপ্ন দেখা সত্তাটিও হারিয়ে যায় রাতের আঁধারে, ক্যামেরাটা পিঠে চাপিয়ে সবুজের সমারোহ খোঁজা চোখগুলো অসহায়ত্ব নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে।
আমাদের সমাজব্যবস্থা এর জন্য দায়ী, প্রত্যেকটা অপমৃত্যুর জন্য সমাজই দায়ী।
সরকারি চাকুরে লোকগুলোর দিকে আঙুল তাক করে দেখিয়ে দেখিয়ে আপনি সমস্ত সত্তাকে পাল্লায় তুলছেন, আপনি সমাজের মানুষ হিসেবে ধরেই নিয়েছেন ছবি তুললে কিংবা ছবি আঁকলে জীবনে কি হবে? কিসে চলবে রুটি-রুজির আয়োজন।
সফল মানুষের(সরকারি চাকুরী প্রাপ্ত) গল্প বলতে বলতে তাকে হয়রান করে তুলছেন চাকুরির পিছনে ছুটতে, নিজের স্বকীয়তা রেখে চাকুরির পিছনে ছুটতে ছুটতে একদিন ক্লান্ত হয়ে উঠে সৃজনশীল মানুষটা তখন আর কিছু করার থাকেনা,হয়ে উঠেনা চাকুরির হয় না আগের সৃজনিতে প্রবেশ করার।
হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে।

ব্যর্থতার জবাবে অহেতুক মায়াকান্না:
হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে একজন মানুষ আপনি তার হাত ধরে টেনে না তুলে গালি দিচ্ছেন মানহীন কাজের, বিবেকহীন প্রকৌশলী সম্প্রদায়ের যাদের জন্য এমন সমস্যার সৃষ্টি।
পাশের বাড়ির লোকটার খাবার নেই দু’মুঠো চাল না দিয়ে আপনি সরকারকে গালি দিচ্ছেন কেন দাম বাড়ানো হচ্ছে!
চাকুরী পাচ্ছে না দেখছেন শিক্ষিত ছেলেটা আপনি তার একটা কর্মের ব্যবস্থা তো করলেনই না আপনি শুরু করলেন কিভাবে ঘুষ,দুনীতি করে মানুষ চাকুরী ভাগিয়ে নিচ্ছেন এমন মানুষের কথা।
আপনার অহেতুক মায়াকান্নার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিভাবান হাজারো মানুষ, শুনেছি এমন কাজের জন্য অনেক মানুষ নিজের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

আপনার পাণ্ডিত্যের গল্পের খারাপ দিক:
আপনি সগৌরবে প্রচার করতে লাগলেন আপনি আমেরিকা হতে পিএইচডি ডিগ্রি করেছেন, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ডিপার্টমেন্ট হতে গোল্ড মেডেলিস্ট!
আর তোমরা কি করছো এই বয়সে?
আমি হেন করছি তেন করছি, কাঁঠাল কাগজে মুড়ে একটু একটু খেয়ে জীবনে এতদূর আসলাম তোমরাতো মানুষই হবে না! যত্তসব গাধার দল।
এইসব গল্প গুলোর আপনার জন্য ভালো লাগার উপলক্ষ্য আনলেও ঠিকই ক্ষতি করছে আমাদের মতো ছোট স্বপ্ন দেখা মানুষ গুলোর জন্য, শেষ বেঞ্চে বসা ছেলেটা মিলাতে পারছেনা তার জীবনের সাথে আপনার কথা গুলো।
হতাশ হয়ে হয়তো বলেই বসে কেন পগাশোনায় সময় অপচয় করছে! কি হবে এমন পড়াশোনায়?

পরিশেষে বলতে চাই, আপনারা বাঁচতে দিন আগামী প্রজন্মকে, চিন্তার স্বাধীনতা দিন তাদের।ভালোবাসুন, প্রতিদিন কয়েকবার বলুন আপনি তাকে ভালোবাসেন।

আমাদের করণীয়:
পাণ্ডিত্য জাহির থেকে বিরত থাকুন
অনুকরণ করা থেকে বের হয়ে আসুন
তুলনা করবেন না
অবস্থান বিচার করতে শিখুন
সাহস ও সত্য অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়ার শপথ করুন।
আপনার মাধ্যমেই পরিবর্তন আসবে তাই নিজেকে সংশোধনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখি আমাদের সুন্দর আগামীকে।

লেখক: আহমেদ হানিফ; শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net