বুদ্ধি, চিন্তন ক্ষমতার উৎকৃষ্টতা সাধনের মাধ্যমে মানুষ সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হলেও কেমন জানি আজ কিছুটা চিন্তনের আবেশন করে আদো মানুষ কি তার যোগ্য দাবিদার কিনা। যোগ্যতার মানদণ্ড কিংবা তর্কসাপেক্ষেও কেউ হয়তো অস্বীকার করবে না তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা। তবে, মাঝেসাঝে অলৌকিক শক্তির মায়াবলে প্রশ্নটার সমাধান করার জন্য তোড়জোড় প্রস্তুতি নিতে দ্বিধা করি না।বোধ ও বোধগম্যতার সংশ্লেষে ভাবি আদো কি আমরা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার কিনা।
এমন প্রশ্ন জাগার ক্ষেত্রে আমার দোষ হলেও তা খণ্ডনের পক্ষে কথা বলে যাবো আজ। তুলির আঁচড়ে দেওয়াল কিংবা ক্যানভাসের আবরণের ফুটে উঠে জানা অজানা শতশত দৃশ্যপট,বদলায় না শিল্পীর অবাক চোখে পৃথিবীর সৌন্দর্য অবলোকন করাকে,নতুনত্বের সৃজন হয়,রয়েসয়ে জীবনের হাল ধরে সস্তায় সত্তাকে বিক্রি করে ফেলা দেহটাও।
সন্ধ্যাকালীন অবসরে দু’কলম লেখার ছুতোয় পৃথিবীর নানান গল্প তুলে ধরার কসুর করি,গুলিয়ে ফেলি ভাবনার জগতকে।নিয়তিকে দোষারোপ করি, হয়তো চারপাশকে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে সঁপে দিয়ে হায় হুতাশ করে সন্ধ্যার সূর্য ডোবার মনোরম ক্ষণটাকে বিষিয়ে তুলি।
বৃদ্ধার গল্প বলার দোষ যেমন মানুষের কাছে বিরক্তির উপলক্ষ্য সৃজন করে তেমনি সুচিন্তিত আত্মার স্বাধীন উপলব্ধির জ্ঞানীয় উপস্থাপনকে দোষের আকর হিসেবে উপস্থিত করে।
তবুও বলার চেষ্টায় বলি- শুনতে ও উপলব্ধিতে বিরক্তির চাপ লাগলেই না শুনার আবেদন বা কষ্টযোগে ক্ষমা করবেন।
আজকের নির্বুদ্ধিতার খেসারত টানার আয়োজনে বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করছি’ পরচর্চা আজ শিল্পের পর্যায়ে ‘নামক অব্যক্ত কথামালার ঝুড়ি নিয়ে।
আজ পাড়ার অচিন্তক মহিলাদের সমাবেশ কিংবা মোড়ের চায়ের দোকানে যেতে হয় না,পরচর্চা যেন আজ শিল্পের রূপ ধারণ করেছে- শ্রদ্ধজনে মাঝে বোধের জাগরণ ঘটিয়ে মোড়ের দোকানকে উপস্থাপন করেন’অকথার পাঠশালা’ বলার কারণ হিসেবে বোধহয় তারা জানাতে চেষ্টা করেন কিভাবে পরচর্চার আসর বসে, বসে অহেতুক গল্পের চলে পরনিন্দা কিংবা অন্যের সমালোচনা। আজ ঘটা করে যেমন আমাদের সামনে তা উপস্থাপন করা হয় তেমনি সহজলভ্য ভাবে আমরা তা সহজে পেয়েও যাচ্ছি। বর্তমানের আধুনিক চিন্তক মানুষের কার্যক্রমের অবিবেচকতার নির্দশন হিসেবে পরচর্চা দেখতে পাই। আত্মভোলা মানুষ যেমন অতীতকে স্মরণে আনতে পারে না, তেমনি পরচর্চার নেতিবাচকতা যেন আমরা জানি না বললেই চলে।
বর্তমানে আমরা ফেসবুক,ইউটিউব,লাইকি,টিকটক সহ যত প্রকারের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আছে তার মধ্যে নিয়মিত যেন এই নিন্দনীয় কাচদজের চর্চা বেড়েই যাচ্ছে। কে কি করছে,কিভাবে করছে তার খারাপ দিকগুলোর উপস্থাপনা যেন শৈল্পিক রূপ লাভ করেছে। আমরা আজ পরচর্চার আসর হিসেবে যোগাযোগ মাধ্যম গুলো ব্যাপক হারে ব্যবহার করছি,শুধু ব্যবহার করছি বললে ভুল হবে নিয়মিত তাতে আসক্ত হয়ে পড়েছি। অনলাইন মাধ্যমে গুলো আজ গর্ব করেই যেন মানুষের সমালোচনা করেই চলেছি,শুধু সমালোচনা করছি এমন নাতো দোষের ময়নাতদন্ত করেই ছাড়ছি।
নানান চমকপ্রদ শিরোনাম দিয়ে মানুষের দোষগুলো প্রকাশ্য নিয়ে আসছি,এবং তার নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমরা যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে দেদারসে বলে যাচ্ছি- মানুষের ভুলের গল্প, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিবরণী, তার কাজের সমালোচনা যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে এইসব পরচর্চাকে সৃজনশীল হিসেবে আখ্যা দিয়ে গর্বের সঙ্গে প্রচার করছে নিজের কীর্তি। এই পরচর্চার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ষোড়শী থেকে শুরু করে অতিশয় বৃদ্ধও। যার ফলে মানুষের মনে নেতিবাচক কাজের বিষয়গুলো মানুষের বারবার আবর্তন করতে থাকে।
মানুষ এখন পরচর্চা করতে গর্ব করে ঠিক যেন তাকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরির নামে মানুষের সমালোচনা করেই ভিউয়ার বাড়িয়ে আত্মিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। নানান চমকপ্রদ তথ্যের মাধ্যমে যেমন পরচর্চা উপস্থাপিত হয় তেমনি আজ প্রতিযোগিতা চলে মানুষকে কিভাবে অন্যের চোখে ছোট করা যায়।
পরচর্চার নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে যেমন ধর্মীয় বিধিনিষেধ আছে তেমনি আগামী প্রজন্মের জন্য পরচর্চা শিল্পের আকার ধারণ করছে।
বর্তমানে ভাবা হচ্ছে যে যত ভাবে মানুষকে ছোট করে তার ভুল গুলো উপস্থাপন করতে পারেন সে তত তাড়াতাড়ি উন্নতি করবে, ভিউয়ার পাবে, আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হবে, বড়লোক হওয়ার জন্যই যেন সমালোচনা হাতিয়ার, কনটেন্ট তৈরির নামে মানুষের সমালোচনা করাই পেশা হবে।
এই পরচর্চা সমাজের গতিশীলতা নষ্ট করে সমাজের মধ্যে, মানুষের মধ্যে নানান ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করে, অতিশয় পরচর্চার মাধ্যমে যে যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি তা হলো
সৃজনশীলতা নষ্ট, অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যা, নির্যাতন, সামাজিক সমস্যা, আত্মহত্যা, পারিবারিক কলহ, রুচির অভাববোধ মানবিক ও মানসিক বৈকল্যতা, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে বলা যায় শরিয়তের পরিভাষায় এমন অনৈতিক চর্চাকে ‘গিবত’ বলা হয়। যার দোষ বর্ণনা করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে যদি সেই দোষ তার মধ্যে থাকে তাহলে গিবত হিসেবে ধর্তব্য হবে।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা অনুমান ও ধারণা (করে কথা বলা) থেকে বেঁচে থাকো। কেননা অনুমান করে কথা বলা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। ’ (বুখারি, হাদিস নং: ২২৮৭)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস। ’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত : ০১)
সামাজিক ভাবে এই পরচর্চাকে মানুষ নেতিবাচক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেন,মানুষ পরচর্চাকারী সামাজিক ভাবে নিগৃহীত করে।
পরিশেষে বলতে পারি, এই পরচর্চাকে ভালো কাজ মনে না করে তার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে ক্ষতিকর বাজে অভ্যাসের বদল করতে পারবো। আশা রাখছি অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম গুলো হয়ে উঠবে সৃজনশীলতা প্রকাশের এক একটি মাধ্যম, মানুষের রুচিবোধ ও চিন্তনের আবেশনে তৈরি হবে সর্বজন জ্ঞাত উপকারী নানা বিষয়। মানুষের ভাবনার বিষয় পরিবর্তন হবে, পরিবর্তন হবে পরচর্চার মতো সমাজ বিবর্জিত এই পরচর্চার বিষয়টি। এমন স্বপ্নে বুকের ক্যানভাসে শত রঙের কালিতে নতুনের আহ্বান জানিয়ে অপেক্ষায় থাকবো পরচর্চা বিহীন এক নতুন সমাজের গল্প বলার জন্য।
লেখক: আহমেদ হানিফ; শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।