নূর ও সারা জাকের দুই দশক ধরে নিয়ন্ত্রণ করছেন দেশের বিজ্ঞাপন বাণিজ্য

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৪ মাস আগে

বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পের বাজার হাজার কোটি টাকার। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দিনের পর দিন দেশের ক্রিয়েটিভ এই সেক্টরে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছেন সাবেকমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং এশিয়াটিকের সারা জাকের।

শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন শিল্প জিম্মীই নয় ভারতীয় আশীর্বাদপুষ্ট আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে রয়েছে গোপন কিলিং চালানোর অভিযোগও। ২০১৩-১৪ সালে তার নির্বাচনী বহরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এর প্রতিশোধ হিসেবে নির্বাচনের পর বিএনপি ও শিবিরের দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সেগুলো গোপন কিলিং মিশন ছিল বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। নির্বাচনের পর নীলফামারীতে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলা ও আওয়ামী লীগের চার নেতা-কর্মী হত্যা মামলার প্রধান আসামি গোলাম রব্বানীর (৩৫) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।শনিবার সকাল সাড়ে নয়টায় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের নীলফামারী-ডোমার সড়কের পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।রব্বানী লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

এরই মধ্যে আসাদুজ্জামান নূরের দুর্নীতির শ্বেতপত্রও প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞাপন শিল্পের লোকজন।

জানা গেছে, নন্দিত কথাসাহিত্যিকের বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয়তা পান আসাদুজ্জামান নূর এবং সারা জাকের। বিশেষ করে ‘অয়োময়’ নাটকের জুটি হিসেবে তারা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ঢুকেন বিজ্ঞাপন শিল্পে। এরপর আওয়ামী লীগের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে একে একে দখলে নেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন খাত। বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি-র কর্ণধার ছিলেন আলী জাকের। তিনি জীবিত থাকাকালীন আসাদুজ্জামান নুর এবং তিনি বিজ্ঞাপন খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার মৃত্যুর পর এশিয়াটিকের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী সারা জাকের।

অভিযোগ রয়েছে, এশিয়াটিক গ্রুপের বাংলাদেশের মিডিয়ার উপর একক আধিপত্য গড়ে উঠার কাহিনীতে রয়েছে সংস্কৃতি ও মিডিয়া বাণিজ্যের আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট।

জানা গেছে, বিগত ২০০৯-২০১৪ আমলে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কয়েকটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শতাধিক ভারতীয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে যে সন্মাননা ও স্বর্ণ পদক দেয়া হয়েছিল তাতে প্রতিটি পদকে বিপুল পরিমাণে সোনা চুরি হয়েছিল। এটা নিয়ে তৎকালীন মিডিয়ায় ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। সেই ইভেন্ট এবং পদক বানানোর কাজটি করেছিল এশিয়াটিক।

রেদওয়ান সিদ্দিকী ববির প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী রিসার্চ উইং সিআরআই এর অন্যতম উপদেষ্টা হলেন এশিয়াটিকের আরেক মালিক ইরেশ জাকের। একারনে আওয়ামী সরকারের নানান বড় বড় ইভেন্টের প্রচারের ব্যবসা গত ১৬ বছর ধরে তারা একচেটিয়া ভাবে করেছে। স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, আইসিটি, এলজিআরডিসহ র্যাব, পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনীর বিজ্ঞাপন ও ইভেন্ট এর নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। এশিয়াটিক ও তাদের প্রতিষ্ঠান মাইন্ডশেয়ার, এম-বি-এ, ওয়েভামকার, এম-পাওয়ার এসব নাম দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের কাজগুলো বাগিয়ে নিয়েছিল। আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি দেখাশুনা করতো গ্রুপ এম এর এমডি মোর্শেদ আলম। এইকারনে প্রতিমাসে তাকে ভারতে যেতে হতো।

ভারত কানেকশন: ২০২০ ও ২০২১ সালে মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি এই দুই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এসেছিলেন। সেই ইভেন্টের গুরুত্বপুর্ন কাজগুলো তাদেরই বিশ্বস্ত এশিয়াটিককে দেয়া হয় । বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেটের ওই ইভেন্ট গুলোতে সে সময় কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছিল।

বিজ্ঞাপনের বাজার দখল: ভারতীয় আনুকূল্যে পাওয়া বিদেশি এফিলিয়েশনকে কাজে লাগিয়ে সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ইরেশ যাকের এর এশিয়াটিক গ্রুপ বিভিন্ন নামে বিগত ১৬ বছরে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, বিকাশ, মারিকো, রেকিট, কোকাকোলা, ডানো, কলগেট, পেপসি এর মত বড় বড় সব বিদেশী ক্লায়েন্টদের মিডিয়া বাজেট কুক্ষিগত করে নেয় । এছাড়াও সাবেক আইজিপি বেনজিরের প্রভাবে ক্রিকেট বোর্ডের হাজার কোটি টাকার মিডিয়া সম্প্রচার সত্ব বাগিয়ে নিয়েছিলেন।

বেসরকারিখাতকে দুর্নীতিকরণ: আওয়ামী সরকার বিভিন্ন চ্যানেল ও মিডিয়ায় গুরুত্বপুর্ন পদে তাদের অনুগত ব্যক্তিদের বসিয়ে একতরফা নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইতিমধ্যেই এদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। একইভাবে এশিয়াটিক মিডিয়া তাদের (Talking point, MCL, Mindshare, Wave Maker, MBA, Mpower Dhonichitro) অধীনে চাকরি করা বিশ্বস্তদের দেশের তিনটি টেলিকম ও বিকাশ সহ বড় বড় সব কোম্পানিতে মিডিয়া ম্যানেজার পদে বসিয়ে দিয়ে প্রাইভেট সেক্টরে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কাজটি সম্পন্ন করে।

সর্বশেষ ৫ আগষ্ট পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের ডেঙ্গু প্রতিরোধে শেখ হাসিনার আহ্বান সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন চালানো হয়। এটি সহ প্রায় ১৫০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বিগত তিন মাসেই বৈষম্যমূলক ভাবে শুধুমাত্র সরকার অনুগত চ্যানেল গুলোতে দেদারসে চালানো হয়। গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মাইন্ডশেয়ার এর রেজা ও অন্যান্য এই সরকারি বিজ্ঞাপন পরিচালনা করতো।

ভুয়া টিভি রেটিং সেল সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও আরাফাতকে হাত করে সরকারিভাবে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানির মাধ্যমে টিভির রেটিং ডাটাকে এককভাবে কুক্ষিগত নেয়। এর ফলে বিভিন্ন মিডিয়ায় সাথে স্বার্থের দ্বন্দ্ব হলেই যখন তখন রেটিং এর অজুহাতে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হতো। এই ভূয়া রেটিং ডাটার কারণে ভারতীয় স্টার জলসা, জি বাংলা সহ বিভিন্ন চ্যানেলে হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশের টেলিভিশন শিল্প কে গড়ে উঠতে না দেয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন গ্রুপ এম এর এমডি মোর্শেদ আলম।

বিদেশে গুজব সেল গঠন: চলতি বছর ভোটার বিহীন নির্বাচনের পর আওয়ামী সরকারের Vision 2041 এর অংশ হিসেবে এশিয়াটিক গ্রুপের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান নূর, ইরেশ যাকের ও গ্রুপ এমের এমডি মোরশেদ আলম ও তার কথিত বান্ধবী মাইন্ডশেয়ার এর ম্যানেজিং পার্টনার তাসনুভা টিনা আলম এই চারজন এশিয়াটিক মিডিয়া এফ জেড ই (FZE) নামে দুবাইতে একটি কোম্পানি খুলে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সময়কদের নামে আইসিটি মন্ত্রী পলকের নির্দেশে জামাত শিবির ট্যাগ লাগানো ও তাদের নামে নানান গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার কাজটি এশিয়াটিক মিডিয়া FZE এর মাধ্যমে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চালু ছিল।

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যোগদান: ১৯ জুলাই শেখ রেহানার পুত্র ববির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইরেশ যাকের অন্য অনেকের সাথে প্রকাশ্যে রবীন্দ্র সরোবরের সমাবেশে যোগ দেন ও নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের রং লাল করে সংহতি প্রকাশ করেন! হাসিনার পতনের শেষ মুহূর্তে আগেরদিন রাতেই নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে বিগত ১৬ বছরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোলা হাসিনা, রেহানা, ববি, বিপু, পলক গং এর সাথে তোলা অসংখ্য ছবি ও তেল মর্দন করা পোস্ট সরিয়ে ফেলেন।

জয় বাংলা কনসার্ট সিআরআই এর সদস্য হিসাবে গত ১৬ বছরে প্রতিটি জয়বাংলা কনসার্টের অন্যতম আয়োজক ছিল এশিয়াটিক এম সি এল। এছাড়াও বিদেশী মিডিয়ায় শেখ হাসিনার উন্নয়ন নিয়ে পি আর পরিচালনার জন্য তাদেরই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ফোরথট এর মাধ্যমে লবিষ্ট নিয়োগ করা হতো প্রতিবার।

মুজিব সিনেমা ২০২৩ এর ইলেকশনের পূর্বে মুজিব সিনেমার সম্পূর্ণ প্রচার (টিভি রেডিও আউটডোর, ডিজিটাল) দেশে এশিয়াটিক ও গ্রুপ এম পরিচালনা করেছে। এই ছবির ফিচার বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রচার ও বিজ্ঞাপনের কাজ করে ফোরথট পি আর ও মাইন্ডশেয়ার।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আসাদুজ্জামান নূরের মোবাইলে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।