নির্বাচন না করার ঘোষণা মেয়র আরিফের

::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

সিলেটের মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী আসন্ন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। ঘোষণা দিয়েছেন নির্বাচন বর্জনের। ঘোষণার সময় বাকরুদ্ধ হয়ে বক্তব্য বন্ধ রাখেন কিছুক্ষণ। চোখ মোছেন চশমা খুলে। এরপর বললেন, আমি শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেছিলাম। জীবন থাকতে এ আদর্শের, দলের ক্ষতি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। আমি বাংলাদেশের সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, আমার মা এবং শ্রদ্ধেয় আলেম-ওলামাদের পরামর্শে এ নির্বাচন বর্জন করলাম।

নগরবাসীকেও নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানান এই বিএনপি নেতা।

তবে নির্বাচন না করলেও নগরবাসীর সঙ্গে আমৃত্যু আছেন বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, সবকিছু গোছানো ছিল। প্রস্তুতি ছিল নির্বাচনের।

অবশেষে অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে স্পষ্ট করলেন, তিনি নির্বাচনমুখী নন, রাজনীতিমুখী। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অবসান হলো আরিফের মেয়র প্রার্থিতা নিয়ে দীর্ঘদিনের ধূম্রজালের। এদিকে আরিফের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পরই নগরজুড়ে আরেক আলোচনা, গুঞ্জন শুরু হয়েছে। আরিফের স্ত্রী শ্যামা হক প্রার্থী হতে যাচ্ছেন!

এদিকে আরিফুল হকের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর খবরে মর্মাহত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, আরিফুল হক নির্বাচনে এলে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতো।

শনিবার বিকালে সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারি মাঠে সমাবেশ করে মেয়র আরিফ নির্বাচন বর্জনের এ ঘোষণা দেন। সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা উপস্থিত থাকলেও কেউ মঞ্চে উঠেননি, বক্তব্যও রাখেননি। মাঠে বিএনপির নেতাকর্মীর চেয়ে জনতার উপস্থিতি ছিল বেশি। মেয়র আরিফ সমাবেশস্থলে যাওয়ার আগে দুপুরে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করেন। এরপর তিনি ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারি মাঠের দিকে যান দুপুর ২টার দিকে।

আরিফ তার বক্তব্যে বলেন, অনেকেই আমাকে উকিল আব্দুস সাত্তার বানানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি সেই সুযোগ কাউকে দিতে চাই না। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন করার পরিবেশ নেই। বিশেষ করে ইভিএম নিয়ে নগরের মানুষজন জানে না। এটা ভোট কারচুপির মহা আয়োজন।

যা বললেন মেয়র আরিফ: তিনি বলেন, নির্বাচনের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়ে গেছে। ইভিএম দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করায় কড়া সমালোচনা করেন নির্বাচন কমিশনের। বিএনপি নেতাকর্মী ও নগরবাসীকে এ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে মেয়র না থাকলেও আমৃত্যু নগরবাসীর সঙ্গে থাকবেন বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নগরবাসীকে ডেকে নাগরিক সভার মাধ্যমে আসছে নির্বাচনে প্রার্থিতার বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন আরও ৩ সপ্তাহ আগেই। সেই ঘোষণা অনুযায়ী সিলেট রেজিস্ট্রারি মাঠে শনিবার নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে মিছিল নিয়ে উপস্থিত হন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাখাওয়াত হোসেন জীবন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন ও কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক।

মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয় নেতাকর্মীদের পদচারণায়। বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, ‘আজ আমি আবারও আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি, কারণ আপনারাই আমার আপনজন। আপনারাই আমাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। আপনাদের ভালোবাসা আর দোয়ার কারণেই আজ আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমার প্রতি আপনাদের ভালোবাসা কতটা তীব্র ও আবেগময় তা গত কয়েকদিনে আমি আরও বেশি উপলব্ধি করেছি। আগামী সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব, নাকি করব না তা আপনাদের উপস্থিতিতে জনসম্মুখে প্রকাশ করাই আমার কর্তব্য মনে করেছি।’

নগরবাসীর উদ্দেশে আরিফ বলেন, ‘আমি আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর আগে আপনাদের কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আপনারাই বলুন তো এই মুহূর্তে সিলেটে কিংবা পুরো দেশে নির্বাচনি পরিবেশ আছে কি? নাই, নাই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন ইভিএম’কে না বলে দিয়েছে, বাংলাদেশের আপামর জনগণ যেখানে ইভিএম’কে না করছে, সেই জায়গায় সিলেটে তারা নিয়ে এসেছে ইভিএম। এটা কিসের ইঙ্গিত? এটা আরেকটি ভোট ডাকাতির ইঙ্গিত। ইভিএম দিয়ে ডিজিটাল ডাকাতির কথা বাদ দিলাম। আপনারাই বলুন, নির্বাচনের আর মাত্র মাসখানেক বাকি আছে। আপনারা কি জানেন কিভাবে ইভিএমে ভোট দিতে হয়? নির্বাচন কমিশন যদি চাইত তারা তো ৬ মাস আগে থেকেই ইভিএম দিয়ে ভোট দেওয়ার প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারত। তারা তা করেনি। কারণ তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না। তারা এবার চায় ডিজিটাল কায়দায় ভোট ডাকাতি। নির্বাচন কমিশনকে আমি একটি চ্যালেঞ্জ দিতে চাই, আপনারা নিরপেক্ষভাবে সিলেটের যে কোনো স্থানে ইভিএম’র ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে জরিপ করে দেখুন। দেখবেন ৯৯ ভাগ মানুষই বলবে তারা ইভিএম চায় না। ইভিএম তারা বুঝে না এবং ইভিএম’র প্রতি তাদের ন্যূনতম আস্থা নেই।’

আরিফুল হক বলেন, ‘এবার ইভিএম বাদ দিয়ে ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলি। ভোট নিয়ে মানুষের আস্থা এমন তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে যে, কোনো নির্বাচন হলেই মানুষ প্রথমেই সন্দেহ করে বলে, ভোট দিনের বেলায় দিতে পারবে নাকি আগের রাতেই শেষ হয়ে যাবে? ভোটাধিকার নিয়ে সাধারণ জনগণের মন থেকে আস্থা উঠে গেছে। এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের নেতাও এখন ভোটের অবস্থা দেখে আড়ালে-আবডালে নিজেরাই লজ্জা পান।’

নগরীর সব ধর্মের মানুষকে উল্লেখ করে আরিফুল হক বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান মণিপুরী সম্প্রদায়সহ ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আমজনতার এ নিঃস্বার্থ ভালোবাসাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কথা দিচ্ছি, মেয়র না থাকলেও নগরবাসীর ঋণ শোধ করার তাগিদে সিলেটের সব কল্যাণমূলক কাজে এবং আপনাদের সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে থাকব।’

এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আরিফ বলেন, ‘আমাকেও একদিন আমার রবের কাছে ফিরে যেতে হবে। সবাই শুধু দোয়া করবেন, আমি যেন সিলেটবাসীর মায়া ও মমতা নিয়েই চির বিদায় নিতে পারি।’

বক্তব্যে নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে উপস্থিত নগরবাসীর উদ্দেশে আরিফ অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই ব্লু-প্রিন্ট রেডি হয়ে গেছে। কিভাবে ভোট ডাকাতি করা যায় তার নীল নকশার অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে পুলিশ প্রশাসনে রদবদল সম্পন্ন হয়েছে। কিছুসংখ্যক আজ্ঞাবহ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের জন্য যেসব উপকরণ দরকার তার সবটুকুই এখন বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, এখনো আমি মনোনয়নপত্র কিনিনি। নির্বাচন করব নাকি করব না সেই সিদ্ধান্ত জানাইনি। কিন্তু তার আগেই আমার নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের একের পর এক মিথ্যা ও সাজানো মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমনকি অনেককে রিমান্ডে পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। বাসাবাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে, হুমকি ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এটাই কি তাদের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনি পরিবেশের নমুনা? আমার দলের নিরীহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সব অপতৎপরতা অনতিবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাই এবং বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করছি।

তিনি বলেন, আমি ছাত্রাবস্থা থেকে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজন কর্মী হিসাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি এবং আমৃত্যু থাকব। এটাই হবে আমার জীবনের শেষ রাজনৈতিক ঠিকানা।

আলোচনায় মেয়রপত্নী শ্যামা হক: মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দলের সিদ্ধান্তে অটল থাকার ঘোষণার পর এখন আলোচনা তার স্ত্রী শ্যামা হককে নিয়ে। নগরজুড়ে গুঞ্জন, মেয়র অনুসারীদের চাপে স্ত্রী শ্যামা হক প্রার্থী হতে পারেন। নিজে প্রার্থী না হলে স্ত্রীর প্রার্থিতায় যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ান এমন দাবি তুলেছেন আরিফের অনুসারীরা। রেখেছেন প্রচণ্ড চাপে। চাপের মুখে থাকা মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমি দলের দায়িত্বশীল, দলকে গুরুত্ব দিতেই হয়। স্ত্রীর প্রার্থিতার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বলেন, এটা উনার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। উনার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার আমার নেই। সমাবেশস্থলে যাওয়ার প্রাক্কালে মেয়র বলেন, তিনি (স্ত্রী) প্রার্থী হলে আমার কোনো আপত্তি নেই।

মেয়রের ঘনিষ্ঠ একজন সহচর বলেন, মেয়র দলের সুতোয় বাঁধা। তিনি দলের জন্য নির্বাচন বর্জন করেছেন। তাই বলে আমরা বসে থাকতে পারি না। আমরাও বিকল্প ভাবনা রেখেছি। বিকল্প হিসাবে মেয়রের স্ত্রী শ্যামা হকের নাম উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রার্থী হলে মেয়র আরিফের চেয়েও বেশি ভোট পাব আমরা। কারণ বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ৮০ হাজার ভোটব্যাংক রয়েছে শুধু (শ্যামা) ভাবির। যা প্রতিবছর আরিফের অ্যাকাউন্টে যেত।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুবার মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ফলে গত দুই মেয়াদে বিজয়ের মুখ দেখেনি আওয়ামী লীগের নৌকা। এবার আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী করেছে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আরিফ নির্বাচন বর্জন করায় এবার নৌকার বিজয় অনেকটা সহজ হয়ে উঠবে বলে রাজনীতিক মহলে আলোচনা চলছে। যদিও মেয়র পদে আরও ৭ জন মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

 

সিলেট/ অমিতা সিনহা/ ২০ মে ২০২৩ ইং