নতুন শরণার্থী গ্রহণের চাপ রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর করবে | কামাল উদ্দিন মজুমদার

:: কামাল উদ্দিন মজুমদার ::
প্রকাশ: ৪ সপ্তাহ আগে

রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি এর মধ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ আরও রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য তীব্র চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। আনুমানিক ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নাফ নদীর একটি এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
জাতিসংঘের অধিকার অফিসের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেন। মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত থমাস অ্যান্ড্রুস বাংলাদেশ সরকারের কাছে “তার বন্ধ সীমান্ত নীতি প্রত্যাহার করতে” এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মানবিক সমর্থন আবারও প্রদর্শন করার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে যে তারা ইতিমধ্যে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আতিথ্য করেছে এবং আর গ্রহণ করতে পারবে না।
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক ঘটনাগুলির ভিড়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুর্দশার দিক থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। মায়ানমার থেকে সমস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা এখনও কোনও দৃঢ় পদক্ষেপে নিতে পারেনি। তারা শুধু মুখে মুখে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকদের প্রত্যাবর্তনের বার বার আশ্বাস দিলেও গত প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে ফেরাতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং অধিকার গোষ্ঠীগুলিকে বুঝতে হবে যে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারে না বা নতুন কোনো অনুপ্রবেশের অনুমতি দিতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকার করে যে রেশনের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সহিংসতা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা জোরপূর্বক নিয়োগ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন ও মঙ্গলকে হুমকির মুখে ফেলেছে। একইভাবে তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে নতুন শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করা রোহিঙ্গারাদের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলময় হবে না।

পুরনো সমস্যা, নতুন চ্যালেঞ্জ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, আর কোনো রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের নাগরিককে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। গত কয়েক দশক ধরে এখানে স্থানান্তরিত হওয়া দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বিশাল বোঝায় পরিণত হয়েছে। তাই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের কোনো নতুন আগমনকে তা বাংলাদেশের জন্য হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
শরণার্থীদের স্থায়ী আবাসস্থল খুঁজে বের করার কোনো সমাধান না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ১৯৮০ এর দশক থেকে বয়ে বেড়ানো বোঝা আর বইতে রাজী নয় । দাতারা ২০২০ সালে প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র ৬০% দিয়েছিলো, যা ২০২২ সালে ৪৯% ও ২০২৩ সালে প্রায় ৫১.৪% এ দাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য হ্রাসের ফলে বাংলাদেশ প্রতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ১.২২ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল আর্থিক বোঝা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য ঋণ চাইতে বাধ্য করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশচ প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ঋণ চেয়েছিল – যার মধ্যে ৫৩৫ মিলিয়ন ঋণ এবং ৪৬৫ মিলিয়ন অনুদান রয়েছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কীভাবে আরও রোহিঙ্গাকে স্বাগত জানাবে!
রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ শুধু আর্থিক সীমাবদ্ধতাই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বিশেষ করে যুবকরা যারা সশস্ত্র সংগঠন এবং অপরাধী চক্রে যোগদান করেছে, তারা অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, স্বর্ণ চোরাচালান এবং অন্যান্য অপরাধে জড়িত হওয়ায় শরণার্থী শিবিরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই আবার এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে এগুলোই জড়িয়ে পরছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫০০ টিরও বেশি অপহরণ এবং ১৮৬ টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা ও রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি বিশাল আর্থিক চাপ তৈরী করছে।
এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশে স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটছে। বাংলাদেশ এখন এমন একটি ফাদে আটকা পড়েছে যে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারে না, যেখানে তারা আরও রক্তপাতের সম্মুখীন হতে পারে, আবার তারা স্থানীয়দের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের জন্য উপযোগী পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারছে না। সুতরাং, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যেটি কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামান্য সহায়তায় কয়েক হাজার শরণার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আবাসন দিয়ে আসছে, বার বার এটি করেই যাবে আর অন্যরা চুপচাপ দেখে যাবে তা আশা করা কপটতা ছাড়া আর কিছু নয়।
চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ বারবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে, তবুও প্রত্যাবাসনের আন্তর্জাতিক কোনো অর্থবহ ও আপাত প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। গত প্রায় আট বছরে, উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহায়তার পরিবর্তে শুধু ফাকা বুলি ও বিবৃতিই দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, উন্নত দেশ, যাদের বিশাল ভূমি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব কম, তারা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ কমানোর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারে। তাছাড়া, তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর প্রদান করতে চাপ দিতে পারে যাতে তারা বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য না হয়।
যেহেতু রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি গুরুতর এবং আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে পুনরায় সংঘর্ষের কারণে প্রত্যাবাসনের আপাত কোনো লক্ষন নেই, তাই বাংলাদেশে অবস্থান করা ১.৩ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার জীবন টিকিয়ে রাখা দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অভিবাসীদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে বাধ্য করার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি সংকটের দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হওয়া।

 

লেখক: কামাল উদ্দিন মজুমদার, কৌশলগত নিরাপত্তা বিশ্লেষক।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]