নতুন রোহিঙ্গা স্রোত বাংলাদেশ কেন বহন করবে | মেহরাব আল মামুন

:: মেহরাব আল মামুন ::
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

২০১৭ সাল থেকে জাতিগত সহিংসতার কবলে পড়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ফলে সৃষ্ট সংকটগুলোর মধ্যে একটি। চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে আবারো মিয়ানমারের রাখাইনের বুথিডং অঞ্চলে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর এ সংঘর্ষে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় ৪৫ হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গা নাগরিক নতুন করে বাস্তুহারা হয়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ছে। যাদের অনেকেই নাফ নদী পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয়ের অপেক্ষায়। কেউ আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নতুন শ্রোতকে ‘কার্যকর সুরক্ষা দিতে’ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকটের সময় আশ্রয় নেয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই এখনো মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। যা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় বোঁঝা। তবে বাংলাদেশ কিভাবে আবারো নতুন রোহিঙ্গা জনশ্রোতকে নিজ ভূ-খন্ডে আশ্রয় দিবে?
প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে মানবতার জননী (মাদার অব হিউম্যানিটি) শেখ হাসিনা যে দরদ দেখিয়েছিলেন বিশ্বের আরো অনেক ধনী দেশও তা এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। কারণ তাদের মানবাধিকার রক্ষার চাতুরতা শুধু মুখের বুলি আর আটি আটি ফাইলে বন্দী কৌশল পত্র ছাড়া আর কিছুই না। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক রাখাইন রাজ্যের বুথিডং শহর থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সেখানে অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মিকে অনুরোধ জানায় যা কার্যত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই না। মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার থমাস অ্যান্ডুস, রাখাইনের চলমান সংকটের প্রেক্ষিতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ‘বন্ধ সীমান্ত’ নীতি থেকে সরে আসতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে ২০১৭ থেকে দীর্ঘ এ সময়ে বিশ্ব সম্প্রদায় এ সংকট সমাধানে কেন একটি কার্যকর সঠিক পন্থা অবলম্বনে ব্যর্থতার পরিচয় দিল? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি হস্তক্ষেপ ও সমর্থন ছাড়া এই সঙ্কট মোকাবেলার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গ্রুপ-উপগ্রুপের দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও নতুন নতুন হুমকি তৈরী করে চলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম কোন না কোন ভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে প্রায় ৭ বছরের বেশী সময় ধরে। বিশ্ব সম্প্রদায়ও কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখছে না। এখনকার নতুন করে সংঘর্ষ সংঘাত আবারো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তুলছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব নেতারা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার টেকসই পদ্ধতি গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে কেন বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের দিকে বার বার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সংকট সমাধানে তাদের কার্যকর ভূমিকায় তারা কেন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে।

গত নভেম্বরে মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই রাখাইন রাজ্য উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি বলছে, তারা স্থানীয় রাখাইনদের আরও স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ে যাচ্ছে কিন্তু মিয়ানমারের ওই রাজ্যে প্রায় ছয় লাখ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমের বসবাস। গত সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজার উপকূলে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার তাদের উদারভাবে গ্রহণ করে আশ্রয় দিয়েছে। তবুও এই উদারতা অর্থনীতির জন্য একটি বড় আকারের বোঝা হিসেবে পরিণত হতে বেশি সময় নেয়নি । বছরে আমাদের এই খাতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। শরণার্থীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং বিদেশি সাহায্য কমে আসায় খরচের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। পাশাপাশি শরণার্থীদের আগমনের কারণে স্থানীয় চাকরির বাজারেও প্রভাব পড়েছে। শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শ্রমের মূল্য কমেছে । ফলে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ দিন দিন কমছে; কমছে আর্থিক সহায়তাও। ফলে রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। গত এক বছরে সরকারের খরচ হয়েছে ১৬৯ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অস্থায়ীভাবে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব ৩৫ কোটি ডলার ব্যয়ে ভাসানচরকে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩১ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান আমাদের উন্নয়ন আকাক্সক্ষার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আতিথেয়তার প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের প্রতিবছর প্রায় ১২২ কোটি ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। এদিকে পর্যাপ্ত অর্থ না আসায় কিছু বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি কমিয়ে আনতে শুরু করেছে। জয়েন্ট রেসপন্স প্লান বা জেআরপির হিসাবে ২০২২ সালে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বা ইউএনএইচসিআর প্রায় ৮৮ কোটি ডলার সহায়তা চাইলেও এসেছে ৬২ শতাংশ। এর আগের বছর আসে ৭০ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৯২ কোটি ডলার চেয়ে পাওয়া গিয়েছিল ৬৯ কোটি ডলার। ২০২০ সালে ১০৫ কোটি ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৮ কোটি ডলার। আর ২০২১ সালে ৯৪ কোটি ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৭ কোটি ডলার।
রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রত্যাশা অনুযায়ী আসছে না। বর্তমানে আরও কম আসছে। মূলত ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, জ্বালানি ও চিকিৎসার মতো বিষয়গুলোতে সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা, জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থা ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। আর শিক্ষার বিষয়টির দেখভাল করে ইউনিসেফ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছনে সরকারের ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৩৭৬ কোটি ৫৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক বন ও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে সৃজিত বনজ দ্রব্যের ক্ষয়ক্ষতি ও জীববৈচিত্রের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ২০৪ কোটি ৬৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
তাই সার্বিক বিবেচনায় নতুন করে রোহিঙ্গা শ্রোত আশ্রয় প্রত্যাশা অনেকটা গোদের উপর বিষফোড়া যা বাংলাদেশ আর নিতে পারবে না, প্রশ্ন উঠে যারা বাংলাদেশকে আশ্রয়ের কথা বলছে তারা কেন যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলেন না? যত দিন যাচ্ছে JRP তে ফান্ড ক্রাইসিস বাড়ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ফান্ড দিচ্ছে না, প্রত্যাবাসনেও কেউ আন্তরিক সহযোগিতা করছে না, বিশ্বের কোন দেশেই এতো উদারভাবে শরণার্থী গ্রহণের উদারহরণ নেই। তাই প্রশ্ন উঠে নতুন রোহিঙ্গা শ্রোত বাংলাদেশ কেন বহন করবে?

লেখক: মেহরাব আল মামুন, গবেষক ও লেখক।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]