নতুন বছরেও সাধারণ মানুষের মনে হতাশার স্রোত

::
প্রকাশ: ২ years ago

মোহাম্মদ আবু নোমান:
একান্ন বছর বয়সী আমাদের প্রিয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। ২০২৩ সাল আমাদের জন্য কতটুকু ভালো সময় থাকবে, আমাদের কষ্ট কতটুকু ফুরাবে, সে উত্তর খোঁজা অতো সহজ নয়। কতখানি সুখে রয়েছি আমরা ও আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যা কোটি টাকার প্রশ্ন? দেশটা গত পঞ্চাশ বছরে এগিয়েছে। আরও এগোতে পারত। যা আমরা দেখছি, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের দিকে তাকিয়ে। ১৯৮১ থেকে ২০০২ মাত্র ২২ বছরে মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় মালয়েশিয়াকে আজ কোথায় নিয়ে গেছেন, তা নিশ্চয় কাউকে নতুন করে বলে দিতে হবে না। ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের শাসক লি কুয়ান মাত্র ৩০ বছরে সিঙ্গাপুরকে তিনি কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, বিশ্ব আজ তা দেখছে।

গত পাঁচ দশকে আমাদের বাংলাদেশের আরও ভালো করার সক্ষমতা ছিল, এখনও আছে। কিন্তু আমরা পেরে উঠছি না। আমাদের রাজনীতি দেশের অগ্রগতিতে যথেষ্ট সহায়ক নয়; বরং নানা ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চারিদিকে বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার বিশাল বৈভব; কিন্তু তার মধ্যেও সাধারণ মানুষের মনে হতাশার স্রোত বয়ে চলছে। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি, ততই যেন স্বস্তিময় জীবন হতে যোজন যোজন দুরে চলে যাচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইউক্রেন, করোনা, যুদ্ধ, এসব শুনতে শুনতেই কেটে গেল ২০২২। একথা শতভাগ ঠিক, নুতন যে বছরটি এসেছে সেটি পুরোনো হতে লাগবে মাত্র ১২ মাস। অর্থাৎ, ২০২৩ সাল কিন্তু মাত্র এক বছরেই, একটি ক্যালেন্ডারেই শেষ হয়ে যাবে! তাই নিজেকে বদলানোর, দেশের জন্য, মানুষের জন্য, পৃথিবীর জন্য কিছু করার প্রত্যয় জাগরিত হোক আমাদের মাঝে নতুন বছরে। পত্রিকার পাতা খুললেই যেন বিষাক্ত না হয়ে ওঠে মন-মানসিকতা। ভালো ও সুন্দর-সুন্দর খবরে ভরে থাকুক পত্রিকার পাতা ও গণমাধ্যমগুলো। দেশপ্রেম জাগ্রত হোক সবার মাঝে। সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা বেড়ে যাক আমাদের মাঝে। মানবতা ছড়িয়ে পড়ুক। সুন্দর হোক গোটা পৃথিবী তথা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। তারপরও এ আশঙ্কা মোটেই আনরেজনেবল নয় যে, ২০২৩ সালটি হবে খুবই অনিশ্চিত, স্পর্শকাতর ও আতঙ্কের! গত কয়েক বছরে আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত কেউই হিসাব মেলাতে পারছে না। কিন্তু এর জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী দুর্নীতি ও আমাদের সিন্ডিকেটকারী ব্যবসায়ীদের অতিলোভ। মানুষের অসহায়ত্ব ও দুঃখকে পুঁজি করে তারা লাভের অঙ্ক রাতারাতি বাড়িয়ে ফেলেন। বর্তমান সরকারেও নীতিনির্ধারণীতে বড় বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন, অথচ সরকারের দিক থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণে কোনো শক্ত পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। আমাদের নিজেদের তৈরি অসংখ্য সংকট- যেগুলোর স্মরণ করতে গেলে হতাশ হতে হয়। আমরা অন্যের দুঃখে দুঃখ পাই না, নিজের সচ্ছলতা আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অন্যের ক্ষতি করতে একবারও ভাবি না।

আমাদের নেতা, পাতি নেতা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিত্তশালীরা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সঞ্চয় করতে চান। শক্তিশালীরা ব্যাংক লুট করে বিদেশে শুধু বেগমপাড়া নয়, নশ্বরের বেহেশত বানাতে ব্যস্ত। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে, দেশের টাকা সরিয়ে নিয়ে পাচার করা হচ্ছে বিদেশে। সে টাকায় কেউ সিঙ্গাপুরে হোটেল কিনছেন, কেউ কানাডা, মালয়েশিয়া, আমেরিকায় বিলাসবহুল বাড়ি। নিউইয়র্কে এক সাবেক মন্ত্রীর গুণধর পুত্র রাতারাতি নগদ ডলারে আধা ডজন অ্যাপার্টমেন্ট কেনার খবর আমরা শুনেছি। গত ৯ জানুয়ারি ঢাকার একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকের খবরের হেডলাইন ছিল, ‘ওয়াসার তাকসিমের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বাড়ি!’ এ সংবাদ প্রচারের পর ওই দিনই বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ি কেনার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা দুটি অভিযোগের অনুসন্ধানের অগ্রগতি জানতে চেয়েছেন।

একটি-দুটি নয়, ১৪ বাড়ি! দেশে নয়, সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। সব বাড়ির দাম টাকার অঙ্কে হাজার কোটি ছাড়াবে। যার মধ্যে একেকটি বাড়ি কিনেছেন, আনুমানিক ১৭ কোটি, ৩৭ কোটি, ৭০ কোটি থেকে ৫৩৫ কোটি টাকা দিয়ে। জানা যায়, বাড়িগুলো তাকসিন ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। দেশ থেকে অর্থ পাচার করে তিনি এসব বাড়ির মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হায়রে অভাগা দেশ! মনে হয়, এদেশের কোনো মা-বাপ নেই। বৃষ্টি ঝড়ছে অথচ মাথার ওপর ছাতা না থাকলে যেমন ঘটনা ঘটা সম্ভব, তাই ঘটছে বাংলাদেশে। এত এত দুর্নীতি করেও চাকরিতে বহাল তবিয়তে থেকে আরও দুর্নীতি, তাও কেউ কিছু বলছে না। পৃথিবীতে এমন হরিলুটের দেশ আর আছে কী? ওপর মহলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এত বড় মাপের পুকুরচুরি অসম্ভব, সে কথা বুঝতে কাউকে শার্লক হোমস হতে হয় না। আর যদি দায়িত্ববান কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অনবহিত হয়, তাহলে তাদের কর্ম ও যোগ্যতার উত্তর কার কাছে? যে দেশে মানি লন্ডারিংয়ে সরকার ও সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত থাকার খবর প্রকাশিত হয়, সেখানে মানি লন্ডারিং বন্ধ হবে কীভাবে?

সম্প্রতি ফুটবল বিশ্বকাপের উত্তাপ ছড়িয়েছে। কাতারে আসলে এক বিপ্লব হয়ে গেছে। যে বিপ্লব মানুষের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করেছে। লাখ লাখ বিদেশি ফুটবল ফ্যানরাও কাতার পৌঁছে অবাক হয়েছেন চোখ ধাঁধানো পরিবর্তন দেখে। কীভাবে বালুর নিচে আধুনিক মেট্রোরেলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলো। কীভাবেই বা হলো পৃথিবীর অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম, এয়ারপোর্ট। যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে এরকম পরিবর্তন আনা যেতে পারে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পরিকল্পনাবিদ, বিশেষজ্ঞ, স্থপতিদের একত্রিত করা হয়। নেয়া হয় তাদের পরামর্শ। কোনো পাবলিসিটি ছিল না। কেউ টেরই পায়নি কবে, কোন কাজ শেষ হয়েছে, কোনটা হয়নি। কোনো লুটপাটের খবরও কাতার তথা বিশ্বগণমাধ্যমে ছিল না। অথচ আমাদের দেশে কাজ চলাকালীন রাস্তা ঢেবে যায়, বিল্ডিংয়ের ছাদ, কালভার্ট ভেঙে পড়ে!

২০২২ সালটা শুরু হয়েছিল কভিডমুক্তির এক বিশাল স্বস্তি নিয়ে, ঘুরে দাঁড়ানোর একটি প্রত্যয় নিয়ে। ধারণা করা হয়েছিল, ২০২২ সালে এসে অর্থনীতি নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবে। সেই সম্ভাবনা উঁকিও দিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশও এ থেকে মুক্ত নয়। ২০২৩ হবে বাংলাদেশের জন্য এক ক্রান্তিকাল। যার সাফল্য নির্ভর করবে সরকার, রাজনৈতিক দল, অর্থনীতিবিদ ও দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ওপরে। এ সময়ে সবার মধ্যে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের পরিচয় যেমন প্রয়োজন, তেমনি এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক ও আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মসংযমী হওয়া আবশ্যক। তবে সবচেয়ে জরুরি বিষয়, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত অকেশনে অতিপ্রয়োজনীয় ছাড়া কোনো খরচ না করা। বৈশ্বিক মন্দার এই সময়ে যতটুকু দরকার, ততটুকু কেনাকাটার মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। প্রতিটি মানুষকে শুধু নিজ ও পরিবারকে নিয়েই নয়, আশপাশের অসহায় মানুষকে নিয়েও ভাবতে হবে। আশপাশের অসহায় মানুষের সাহায্যে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করতে হবে। মানুষকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সাহায্য করতে পারা অনেক ভাগ্যের।

বাংলাদেশে ২০২২ সাল কেটেছে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে। দরিদ্র নিম্নআয়ের মানুষের স্তর পেরিয়ে মধ্যম আয়ের মানুষও দৈনন্দিন খরচ নিয়ে প্রচ- চাপে রয়েছে। অনেকটা অলক্ষে বেড়ে গেছে চিকিৎসা-ব্যয়। মানুষের অসুখ ও স্বাস্থ্য সংকটও বাড়ছে। বিগত বছর পদ্মা সেতু ও প্রথম মেট্রোরেল দেশের অবকাঠামোগত উন্নতির স্মারক। যদিও দেশের দুর্নীতি, অনিয়ম, ঋণখেলাপের লাগাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক সহনশীলতা, ভোটাধিকারের চিন্তায় কেউ স্বস্তিতে নেই। বৈশ্বিক মহামারী কিংবা যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারের যে অস্থিতিশীলতা সেখানে বাংলাদেশের হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। কিন্তু রাষ্ট্র যা ঠেকাতে পারে তা হচ্ছে ঘুষ, দুর্নীতি, তহবিল লুণ্ঠন ও পাচার। ক্ষমতার সমর্থন ছাড়া সংগঠিত দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবার আগে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করা জরুরি।

তাবৎ পৃথিবীব্যাপী সমাজ, দেশ এগোচ্ছে না পেছোচ্ছে, ভাঙছে না গড়ছে তা শনাক্তকরণে এক শ্রেণি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে মেধা ও মননকে কাজে লাগায়। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ী হোক, চাকুরি বা শিল্পোউদ্যোক্তা হোক, কি সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের হোক, দেশে ভালোটার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। আমাদের দেশের জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবী, আলেম, পীর, সবার মধ্যেই বড় একটি একটি সমস্যা হলো- সকলেই তার নিজের বোধ-বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করতে চায়। সে তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরিখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে।

সামনে রাজনৈতিক বিরোধ আরও ঘনীভূত হবে এবং তা আরও সংঘাতের দিকে যাবে, যেমনটি আমরা দেখেছিলাম ৯/১১ ও ২০১৪-১৫ সালে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। আওয়ামী লীগের অন্যতম অস্ত্র হলো বর্তমান সংবিধান। এটা ‘মহাপবিত্র’ ঊর্ধ্বোলোকের আমানত, বদলানো যাবে না, সম্ভবইনা। বিএনপি চায়, সংবিধানের সংশোধন। সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর এই অবস্থানে সংকট বাড়ছে, জল আরও ঘোলা হচ্ছে।