দেশের সুনাম বনাম ড. ইউনূসের বিদেশি লবিং

::
প্রকাশ: ২ years ago
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি

সম্প্রতি, শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আচরণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন ৪০ বিশ্বনেতা। এ বিষয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলাচিঠি দিয়েছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্টে ৭ মার্চ পূর্ণ পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ উদ্যোগের কৃতিত্বের উল্লেখ করে, জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব বান-কি মুন এবং প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের এই নোবেলজয়ীর সাথে ‘হয়রানি’ বন্ধ করতে সরকারী সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করেছেন।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

অতীতেও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিবর্গ ড. ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশের ওপর এই চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইউনূস অভিযোগ করছেন তিনি সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। পরবর্তীতে যখন তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল, তখন তিনি বাঘা বাঘা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে সম্পৃক্ত করে অনিয়মের দাবী তুলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার চেষ্টা করেছিলেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো, তার প্রচেষ্টা এবং দাবীগুলো অযৌক্তিক যা দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নিকট খোলা চিঠি এবং বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৭৮ লক্ষ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন প্রচারও অযথা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পায়তারা হিসাবেই গণ্য হচ্ছে।  একজন প্রবীণ অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে ড. ইউনূসের উচিৎ বিদেশি লবিং না করে দেশের আইনকে সম্মান করা এবং বৈশ্বিক গণমাধ্যমে অহেতুক ‘ভিক্টিম কার্ড প্লে’ না করা।

অভিযোগ ঢাকতে বিদেশি লবিং?

ড. ইউনূস একসময় দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচেষ্টার জন্য দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তবে কর ফাঁকি, দাতা তহবিলের অবৈধ স্থানান্তর, বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করা থেকে পদ্মা সেতুর তহবিল বাতিলে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিদেশী ভ্রমণ বিধি লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তার খ্যাতি মাত্রাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। নরওয়েভিত্তিক ‘পিস কমিটি’ কতৃক ড. ইউনুসকে ‘নোবেল’ পুরস্কারে ভূষিত করা হলেও সেই রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনেই তাকে নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা সরানোর বিষয় সম্পর্কিত তথ্যচিত্র সম্প্রচারিত হয়েছিল একযুগ আগে। বর্তমানে অনুসন্ধান চলছে গ্রামীণ টেলিকমের দুর্নীতি। ২০১৫ সালেও তিনি বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন কারণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃপক্ষ তাকে ৭৭০ মিলিয়ন টাকার বিপরীতে ১৫৩.৯ মিলিয়ন টাকা কর পরিশোধ না করার জন্য তলব করেছিল। তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে গঠন করেছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস তার নিজের স্বার্থে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় অবৈধভাবে তহবিল স্থানান্তর করেছিলেন বলেও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি তার বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকম ইউনিয়নের শ্রমিক ও কর্মচারীদের দায়ের করা ১১০টি মামলার সবগুলোই বেআইনিভাবে নিষ্পত্তি করেছেন। এ বিষয়ে ২০২১ সালে ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে ঢাকার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতর। পরবর্তীতে ১৭৬ জন শ্রমিককে পাওনা বাবদ ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে বিষয়টি সমঝোতা করেন ড. ইউনূস।

দেশের ১/১১ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে তার ভূমিকা বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে সুশীল সমাজের সদস্যদের কাছে তীব্র সমালোচিত হয়েছে। মূলত এরপর থেকেই তিনি দেশে বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। এছাড়াও দেশ-বিদেশের জনগণ ভাল করেই জানে যে তিনি বিদেশি লবিং এর মাধ্যমে নিজেকে এবং গ্রামীন প্রতিষ্ঠানকে অতিরঞ্জিতভাবে মহৎ করার চেষ্টা করেন। ২০২২ সালে ড. ইউনূসকে মহানায়ক বানানোর তৎপরতা শুরু করে মার্কিন লবিং। একই বছরের ৬ অক্টোবর ইউনূসকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্রনিউজ। যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ডে দেশটির একটি এনজিওর অর্থায়নে চলে অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি। প্রতিবেদনটি করেন বিতর্কিত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। এর এক সপ্তাহ পর ১৩ অক্টোবর ইউনূসকে মহানায়ক বানিয়ে খবর প্রকাশ করে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট।

সরকারের লক্ষ্য দুর্নীতি ও অনিয়ম, ড. ইউনূস নয়

বাংলাদেশে ইউনূস বিতর্কের শুরু অনেক আগেই। তবে ২০১১ সালে যখন সরকারী কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রামীন ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর আদেশ দেন, তখন থেকেই সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আসতে শুরু করে। ড. ইউনূসের কয়েকজন প্রভাবশালী বন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেও এ বিষয়ে অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের জানান যে, সরকারের এখানে কিছু করার নেই কেননা আইন তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হিসেবে থাকতে দেয়নি। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অবসরের বয়স ৬০ বছর। অন্যদিকে ড. ইউনূসের তখন বয়স ছিল ৭০ বছর। ফলে তার রিভিউ পিটিশন ২০১১ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দেয়।

পরবর্তীতে ড. ইউনূস এই পদ আঁকড়ে ধরা কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর বৈদেশিক লবিং দিয়ে চাপ প্রদান শুরু করেন। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারকেও এমডি পদ ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি লবিং করতে নিযুক্ত করেছিলেন। হিলারি ক্লিনটন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু সেটা কারো অজানা নয়। বিভিন্ন সময় যে তিনি হিলারিকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছিলেন তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মার্কিন সহযোগী যারা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ প্রোগ্রামের সাথে কাজ করে, তাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন ফাউন্ডেশনে এক লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষ ডলার দান করার জন্য। পাশাপাশি গ্রামীণ রিসার্চ ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে পচিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার দান করেছে। এই অনুদান হিলারির লবিং এবং সমর্থনের সাথে তাকে বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ক্ষমতায়িত করার জন্য ভালোভাবে যুক্ত হতে পারে।

বাস্তবতা বলছে, ড. ইউনূসকে নিয়ে সরকারের কোনো সমস্যা নেই। দুদক এবং এনবিআরসহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কেবলমাত্র গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলির অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে তাদের নিয়মিত কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য কোন ব্যক্তিবিশেষ- তথা ড. ইউনূস নয়। এমনকি ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য সরকারের কোন বিশেষ ক্ষোভও নেই। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকে ৪ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স দেন এবং ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হিসাবে লাইসেন্স দেন। সে সময় গ্রামীণ ফোনের টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে জমা হবে বলে জানানো হয়েছিল। বর্তমানেও সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের দুর্নীতি ও অনিয়ম খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, ইউনূসকে দোষারোপ করছে না। মনে হচ্ছে প্রফেসর ইউনূসের নিরাপত্তাহীনতা তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে যে, এই মামলা এবং তদন্তের উদ্দেশ্য তাকে হয়রানি করা।

বর্তমানে দুদক এবং এনবিআর সহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো কেবলমাত্র গ্রামীণ সংস্থাগুলির তদন্তের নিয়মিত কাজ করছে, ব্যক্তি ইউনূসকে নিয়ে নয়। তদন্ত তাদের নিয়মিত কাজ, ‘হয়রানি’ নয়। বরং বহু অনৈতিক কাজের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ড. ইউনূসকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট এমন খোলা চিঠি সরকারের প্রতি হয়রানিমূলক প্রচেষ্টা। সম্ভবত নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন দিয়ে আলোচনায় আসতে চাইছেন ড. ইউনূস। তবে এর মাধ্যমে সরকারকে বিব্রত করা ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের পাশাপাশি একজন নোবেলজয়ী হিসেবে নিজের মর্যাদাকেও খাটো করলেন তিনি। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ইউনূসকে অবশ্যই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে হবে এবং বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থী কোনো বিতর্কিত কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি তাকে বিদেশী লবিং এবং গণমাধ্যমে ভিত্তিহীন বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করতে হবে কেননা এটি কেবল সরকারের উপর চাপ প্রদান এবং দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করবে।

 

লেখক: ইশতিয়াক ফারদিন, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং লেখক।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net