খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রতারক চক্রটি বিশেষ করে মন্ত্রী-এমপি পর্যায়ের ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান- এমন ব্যক্তিদের তারা টার্গেট করেছে। চক্রটি তাদের টার্গেট তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের ফোন করে নিজেদের ‘দুদক কমিশনার’, ‘দুদক পরিচালক’ কিংবা ‘উপপরিচালক’ পরিচয় দিচ্ছে। কথোপকথনের সময় প্রতারকরা তাদের হাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ থাকার কথা জানায়। এক্ষেত্রে তারা কখনও কৌশলে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য ডেকে থাকে। কাউকে আবার বলা হয়, তার নামে চিঠি আছে, তিনি যেন সেটা নিয়ে যান। অবস্থা বুঝে অভিযোগ থেকে নিষ্পত্তি করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ফোনে কারও এসব কথায় ভয় পাওয়ার আভাস পেলে বা বিষয়টি অন্যভাবে ম্যানেজ করার কথা শুনলেই তারা সুযোগ নিয়ে নেয়। এভাবে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেককে ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। তবে সব ক্ষেত্রেই যে এ কৌশল কাজে লাগে তা-ও নয়। অনেকেই সন্দেহবশত খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হন যে দুদক কর্মকর্তা সেজে তাদের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ অভিযোগ তুলে নেওয়ার টোপ গিলে প্রতারকদের কথামতো টাকাপয়সা দিয়েছেন। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে কথোপথনের একাধিক কল রেকর্ডও নমুনা হিসেবে পাওয়া গেছে।
‘দুদক কর্মকর্তা’ পরিচয়ে প্রতারক চক্রের সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক বলেন, ‘আমরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে টিভিতে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এরপরও মানুষ কেন প্রতারকের পাল্লায় পড়ে বুঝি না। এরপরও যারা প্রতারণার শিকার হয়, বুঝতে হবে তাদেরই সমস্যা আছে।’
জহুরুল হক আরও বলেন, দুদক তাদের আইন অনুসারে কারও সম্পদের তথ্য জানতে চাইলে তার সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে চিঠি পাঠায়। প্রয়োজন হলে তাকে চিঠির মাধ্যমে ডেকে পাঠিয়ে তার বক্তব্য শোনে। তদন্তের স্বার্থে সেটা রেকর্ড করে। কাউকে ফোন করে ডাকার কোনো নিয়ম নেই।
প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, ‘আমাদের ক্ষমতা হচ্ছে দুর্নীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে। দুদক সেটাই করে। প্রতিরোধের জন্য আমরা প্রচারণা চালাতে পারি, সেটাও আমরা করছি। এখন যারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, তারা যদি আমাদেরকে তথ্য দেন তখন আমরা কিছু করতে পারি। অভিযোগ জানালে আমরা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে যুক্ত করতে পারি। তা না হলে তো পারব না।’
যে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তাতে দেখা যায়, দুদকের নামে প্রতারক চক্রটি ফোন দেওয়ার পর বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য তাদের সহকারীর মাধ্যমে দুদকের সেগুনবাগিচার কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছেন। এর ফলে তারা জানতে পেরেছেন, দুদকের নামে ফোনকলের বিষয়টি সত্যি নয়। অন্যদিকে অনেকে কথিত অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে ‘দুদক কর্মকর্তা’ পরিচয় দেওয়া প্রতারক চক্রের সদস্যদের সঙ্গেই ‘রফা’ করেছেন। তাদের কেউ ৫ হাজার, কেউ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গচ্চা দিয়েছেন। এই রফা করতে গিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একাধিকবার ফোনকলে কথাবার্তা চালাচালিও হয়েছে।
প্রতারণার ফাঁদে কারা?
এখন পর্যন্ত প্রতারক চক্রটি ঠিক কতজনকে ফোন করেছে বা কতজন তাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। তবে দুদক সূত্রে জানা যায়, এ সংখ্যা অনেক। দেড় থেকে দুই ডজনের কম হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতারকরা যাদের ফোন দিয়েছে তাদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, ঢাকা-১৫ আসনের এমপি ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারও রয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছেন- কুমিল্লা-৭ আসনের এমপি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের এমপি একেএম শাহজাহান কামাল, ময়মনসিং-৮ আসনের ফখরুল ইমাম, দিনাজপুর-৬ আসনের শিবলী সাদিক, নেত্রকোণা-৫ আসনের ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, খুলনা-৬ আসনের আক্তারুজ্জামান বাবু এবং বগুড়া-৩ আসনের সাবেক এমপি ইসলাম তালুকদার ও লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি মোহাম্মদ নোমানসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং বর্তমান ও সাবেক এমপি।
এ ছাড়া প্রতারকরা আরও যাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি জিল্লুল হাকিম, ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকী, পাবনা-৩ আসনের এমপি মকবুল হোসেন। ফোনকল পেয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুও।
ঢাকা-১৫ আসনের এমপি শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারকে ফোন করে প্রতারক চক্রটি। এ বিষয়ে জানতে কামাল মজুমদারকে ফোন করা হলে সেটি ধরেন তার গানম্যান তাসনিম আলম। কী বিষয়ে কথা বলতে চাই তা জানতে চান তিনি। সব শোনার পর তাসনিম আলম বলেন, ‘বিষয়টি সঠিক। আমি দুদকে গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে, স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন। দুদকে যাওয়ার পর ওই লোক আর আমার সঙ্গে দেখা করে নাই, কালক্ষেপণ করছে।’
‘দুদক কর্মকর্তা’ পরিচয়ে ফোন করে কী বলেছে জানতে চাইলে ওই গানম্যান ফোনটি কামাল আহমেদ মজুমদারকে ধরিয়ে দেন। ফোনে কামাল আহমেদ মজুমদার প্রতারক চক্রের কাছ থেকে কল পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘দুদক থেকে আমার কাছে কোনো ফোন আসে নাই।’ তবে প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখা যায়, গত ১৭ মে বিকাল ২টা ৫৫ মিনিটে প্রতারক চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে ৬২ সেকেন্ড কথা বলেন কামাল মজুমদার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের এমপি ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল স্বীকার করেন যে দুদকের পরিচয়ে তার কাছে ফোন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রতারকরা ফোন করে জানায়, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। তারা বলেÑ আপনার নামে একটি চিঠি আছে। দুদক থেকে এসে এটা নিয়ে যান। আমি তখন বললাম, আমি তো নিজেই চলতে পারি না। দুর্নীতি তো দূরের কথা! তারা আবারও বলে, দুদকে এসে চিঠি নিয়ে যান।’
শিমুল জানান, পরে তিনি তার পিএসকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে দুদকে পাঠান। জানতে পারেন, প্রতারক চক্রটি দুদকের যে কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে ফোন করেছে, ওই কর্মকর্তা তার নামে কোনো চিঠি ইস্যু করেননি। দুদক তাদের এটাও জানায়, সম্প্রতি এমন অনেকের সঙ্গেই এ প্রতারণা হচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যানের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানান এমপি শিমুল।
কললিস্ট থেকে দেখা যায়, তার সঙ্গে দুবার কথা হয় প্রতারক চক্রের সদস্যের। ১৭ মে ৫২ সেকেন্ড এবং পরদিন ৭৬ সেকেন্ড তাদের কথোপকথন হয়।
একই বিষয়ে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শাহজাহান কামালকে ফোন করলে ফোনটি ধরেন তার স্ত্রী। তিনি জানান, শাহজাহান কামাল অসুস্থ, তাই বিষয়টি যেন তাকেই জানাই। প্রতারক চক্রের ফোনকলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বেশি দিই নাই। মাত্র ৫ হাজার টাকা না যেন ১০ হাজার টাকা দিছি। এ রকমই হবে।’ তিনি এর বেশি আর কিছুই বলতে চাননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে আরও জানা যায়, প্রতারক চক্রটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের এমপি বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেনকে ফোন করে। তবে ফরহাদ বলেন, ‘আমাকে দুদক পরিচয়ে কেউ ফোন করেনি। তবে একটি নম্বর থেকে ফোন করে বলেছে আপনার মনোনয়ন কনফার্ম, আপনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আপনি আমাদের চা-পানি খাওয়ার জন্য কিছু দিয়েন।’
প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে যে কললিস্ট এসেছে তাতে দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের এই সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদ মাহমুদ প্রতারক চক্রের একটি নম্বরে (০১৩…৯০৯) গত এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখে মাত্র এক দিনেই ১৮ বার ফোনে যোগাযোগ করেন। তাদের মধ্যে মোট ৭৯৫ সেকেন্ড কথা হয়।
এ রকম আরও কয়েকজন এমপির ক্ষেত্রে কথিত অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেতে প্রতারক চক্রের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে বলে জানালেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে সম্মত হয়নি।
সৌজন্যে: দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ।