২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার কর্পূরের মতো হাওয়া হয়ে যায়। আর এ ঘটনা কম-বেশি আমাদের সবার জানা। তবে ঘটনার তদন্তে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী সাবেক দুই মন্ত্রীর বলপ্রয়োগসহ কত কী যে হয়েছে, তা অনেকেরই অজানা।
২০২০ সালের ১ নভেম্বর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছোট সম্মেলন কক্ষে উচ্চ পর্যায়ের একটি সভা আয়োজন করা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সভার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ততদিনে ওই ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ করে এনেছে। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে তদন্তের গতিপথ বদলে দেয়ার জন্য তদন্তকারী সংস্থাটির ওপর চাপ প্রয়োগ করেন দুই মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের তৎকালীন দুই সচিব।
তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেশী অপরাধীদের নাম বাদ দেয়ার নির্দেশ দেন তারা। যদিও সিআইডির তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, প্রতিবেদন থেকে দেশী অপরাধীদের নাম কোনোভাবেই বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ তাদের অনেকেরই সরাসরি সংশ্লিষ্টতার তথ্যপ্রমাণ ও আলামত এরইমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এরপরও থেমে থাকে না সংশ্লিষ্টদের চাপ প্রয়োগ। একপর্যায়ে মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সিআইডির নেতৃত্বে আনা হয় পরিবর্তন। পাশাপাশি মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত ফরেনসিক প্রতিবেদন ও অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) হাতে তুলে দেওয়ার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়।
আর এতে অসম্মতি জানাতেই বাধে বিপত্তি। তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির তিন কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বদলি করে দেওয়া হয়। আর নতুন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিনকে।
তার ওপর দেশি অপরাধীদের নাম বাদ দিতে তৎকালীন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জোর চাপ প্রয়োগ করা হয়। একই সঙ্গে তদন্তের ফলাফলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির মাধ্যমে তদন্তের ফরেনসিক ও অন্তর্বর্তী অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে দেওয়া হয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে। পরে রিজার্ভ চুরির তদন্ত ও মামলার কার্যক্রম সেখানেই থমকে যায়। এরপর কেবলই দীর্ঘসূত্রিতা। এ পর্যন্ত ৭৯ বার সময় নিয়েও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সিআইডি।
সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, দুই মন্ত্রীর নির্দেশে এভাবে কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত আটকে দেয়া হয় তা জানা দরকার। বাংলাদেশে সিআিইডি তদন্ত করেছে। এখন পর্যন্ত ৭৯বার সময় নিয়েছে কিন্তু চার্জশিট দেওয়া হয়নি। শোনা যায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাপ দিয়েছিল যেনো কোনো চার্জশিট না দেওয়া হয়, আর কোনো বাংলাদেশিকে যেনো এখানে যুক্ত না করা হয়।
সিনিয়র আইনজীবী আরও বলেন, চার্জশিট জমা না দেওয়া কার স্বার্থে এটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাদের কাছেই জানতে হবে সিআইডি চার্জশিট তৈরির পরেও কেন দিতে পারেনি আর তাদের কেনো চাপ দেয়া হয়েছে।
সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এর জন্য দায়বদ্ধ বাংলাদেশের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর। তদন্ত হয়েছে, আর সেটি জনসম্মুখে দেখতে চাই। এবং অপরাধী যারা তাদের গ্রেপ্তার করে অতি শিগগিরিই বিচারের মুখোমুখি করা দরকার।
প্রসঙ্গত, রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত অগ্রগতি নিয়ে সবশেষ গত ১৪ জুলাই সিআইডি সদর দপ্তরে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আজমালুল হোসেন কিউসি, বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান মাসুদ বিশ্বাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ছিল এই মামলার প্রতিবেদন দাখিলের ৭৯তম দিন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে না পারলেও শিগগিরই প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিনের জন্য আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।