দখলের মুখে ঢাকার ২৬ শতাংশ জলাধার

:: পা.রি. রিপোর্ট ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে
“ঢাকায় পুকুর ও জলাধারের প্রয়োজনীয়তা এবং সংরক্ষণে করনীয়” শীর্ষক সেমিনার বক্তারা। ছবি: সংগৃহীত

একটি বাসযোগ্য শহরে কমপক্ষে ১০-১৫ শতাংশ জলাশয় থাকা দরকার হলেও ঢাকার জলাশয়-জলাধার আশংকাজনকভাবে কমছে। ঢাকার জলাধারগুলো নির্বিচার দখলের শিকার। ড্যাপ (ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা), নগর উন্নয়ন আইন, জলাধার সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকে অমান্য করে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ডিআইটি পুকুর দখল-সহ এই নগরীর আরো বিভিন্ন পুকুর ও অন্যান্য জলাধার দখল ও ভরাট হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের।
আজ বৃহস্পতিবার (২২ জুন ২০২৩) এক সেমিনারে পরিবেশবিদ ও পরিবেশকর্মী, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, সংসদ সদস্য এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বাংলাদেশ ন্যাচার কনজারভেশন অ্যালায়েন্স-বিএনসিএ) ও গেন্ডারিয়ার ডিআইটি পুকুর রক্ষা আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে “ঢাকায় পুকুর ও জলাধারের প্রয়োজনীয়তা এবং সংরক্ষণে করনীয়” শীর্ষক এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনসিএ এর আহ্বায়ক ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ দেখান যে, ঢাকা মহানগরীর অবশিষ্ট ৩২৭ পুকুর ও জলাশয়ের মধ্যে ৮৬টি (যা প্রায় ২৬%) এখন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি কর্তৃক দখলের পথে। এই জলাধারগুলোর মধ্যে ৬টি দখল হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে, ৭৯টি দখল হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে এবং বাকি একটি দখল হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে।
জলাশয় দখল ও কমে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি- বেলা এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পানির শহর ঢাকাকে আমরা কারবালায় পরিণত করেছি। এই নগরী সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। এজন্য অন্য অনেকের সাথে রাজউককে দায়ী করে তিনি বলেন, ”রাজউক একটি সাংঘাতিক অস্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান নিজেই জলাশয় ভরাট করে হাউজিং করছে।”
সেমিনারে আরো আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা-৪ আসনের এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারি পরিচালক বজলুর রশীদ; বিএনসিএ এর যুগ্ম আহ্ববায়ক ও নোঙর ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী সুমন শামস, বিএনসিএ-র সদস্য সচিব ও সেভ আওয়ার সি’র সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক; ও নিরাপদ ডেভেলাপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা।
আরো বক্তব্য রাখেন পরিবেশ সংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন ‘ইনিশিয়েটি ফর পিস (আইএফপি)’ এর চেয়ারম্যান এডভোকেট শফিকুর রহমান, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী শাকিল, গেণ্ডারিয়া ডিআইটি প্লট পুকুর রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক ইব্রাহীম আহমদ রিপন প্রমুখ।
ন্যাচার লাভিং পিপল (এনএলপি)- এর সভাপতি এহসানুল হক জসীম, সেভ ফিউচার বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক নয়ন সরকার, বায়ু মণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), পরিবেশ উদ্যোগ, সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন, ব্লু গ্রীন ফাউন্ডেশন ইত্যাদি আরো বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পুরান ঢাকার বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ-সহ গেণ্ডারিয়া এলাকা সচেতন নাগরিকরা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ উল্লেখ করেন, তাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে মোট ৬৩টি খাল, ১৩টি লেক ও একটি আদি চ্যানেলের অস্থিত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, নিজেদের প্রয়োজনে এসব পুকুর ও জলাধার রক্ষা করতে হবে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে ঢাকার অবশিষ্ট জলাধারগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারে।
এই নদী ও জলাধার গবেষক বলেন, আইন অনুযায়ী যে কোন ধরণের জলাধার ভরাট নিষিদ্ধ। ব্যক্তি মালিকালাধিন হলেও জলাধার ভরাট করা যে যাবে না, এই ব্যাপারে রাজউকে সার্কুলার ইস্যু করতে পারে। রাজউক আরো সক্ষম ও সক্রিয় হলে ঢাকার জলাধার রক্ষা পাবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারিভাবে জলাধারের এখনো কোন তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এটা করা দরকার। প্রতিটি পুকুরের সামনে এখনই সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, পুরান ঢাকার ডিআইটি পুকুর দখলমুক্ত রাখার ব্যাপারে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যারা এই পুকুর দখল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। রাজউক কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়ার পরও ডিআইটি পুকুরে যে অবশিষ্ট স্থাপনা রয়েছে, তা সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কাজ অব্যাহত রাখবেন বলে ঘোষণা দেন।
ঢাকা-সহ সারাদেশের কোথাও পুকুর ও জলাশয় ভরাট করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী সংসদ অধিবেশনে পরিবেশ ও জলাশয় ইস্যুতে তিনি কথা বলবেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তার বক্তব্যে বলেন, এই নগরীর কোন দর্শন নেই। মেয়রের উন্নয়ন ধারণা জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের উন্নয়নের দর্শন পাল্টাতে হবে। প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জলাশয় ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে।
গেণ্ডারিয়া পুকুর-সহ বিভিন্ন পুকুর, জলাশয় ও মাঠ রক্ষার দায়িত্ব যাদের তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় এসব হারিয়ে যাচ্ছে, প্রভাবশালী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দখল হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের সোচ্চার ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, গেণ্ডারিয়ার পুকুর রক্ষা পাচ্ছে স্থানীয়দের প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে। ডিআইটি পুকুর রক্ষায় আন্দোলন করে স্থানীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ঢাকা নগরীর বিভিন্ন জলাশয় এবং মাঠ রক্ষায় রাউজকের ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজউকের দ্বৈতনীতি এবং বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুকুর ও জলাশয় দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন দর্শন ছাড়া রাজউক বিভিন্ন কাজ করছে। রাজউক-সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ২০ বছরের একটা পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে এই নগরীর প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়।
আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেশহারে পরিবেশ ইস্যু যাতে গুরুত্ব পায় সেজন্য এখন থেকে পরিবেশবাদিদের কাজ করার উপর তিনি তাগিদ দেন। পরিবেশ বিধবংশী এবং নদী ও জলাশয় দখলদাররা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, সে ব্যাপারে পরিবেশবাদিদের ভূমিকা রাখতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের বজলুর রশীদ তার বক্তব্যে ঢাকা নগরীতে অগ্নি নির্বাপনে পুকুরের গুরুত্ব তুলে ধরেন। পুরান ঢাকার মতো ঘনজনবসতিপূর্ণ ও সংকীর্ণ রাস্তা সম্বলিত এলাকায় অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ডিআইটি পুকুর-সহ বিভিন্ন পুকুরের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় নতুন করে আরো কিছু পুকুর খনন করা একান্ত প্রয়োজন।