চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জেলার বিকল্প সড়কের ব্যস্ততম তৈলারদ্বীপ সেতু টোলমুক্ত করার দীর্ঘদিনের দাবী ছিল সচেতন মহলের। গেলো ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পরপরই এই সেতুর টোল অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন দুর্বৃত্তরা; একই সাথে ঘোষণা করেন এই সেতুর টোলমুক্ত। এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত টোলমুক্ত রয়েছে এই সেতুটি চলচলকারী যানবাহন ও মালবাহী গাড়ীগুলো।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জেলার বিকল্প সড়ক হিসেবে পরিচিত আনোয়ারা-বাঁশখালী সীমান্তে শঙ্খ নদীতে তৈলারদ্বীপ সেতুর ভিত্তিস্থাপন করেন। ২০০৫ সালের শেষদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেতুটির শুভ উদ্বোধন করেন। তখন থেকেই এই সেতুতে টোল আদায় শুরু হয়।
সচেতন মহলের যুক্তি হচ্ছে, একই শঙ্খ নদীর ওপর দোহাজারী সেতু, চন্দনাইশ সেতু, সাতকানিয়ার ডলু ব্রীজ ও খোদারহাট সেতু নির্মিত হয়েছে। এসব সেতুতে কখনোই টোল আদায় করা হয়নি। ব্যতিক্রম হলো তৈলারদ্বীপ সেতুর ক্ষেত্রে। এই সেতু নির্মাণে কোনো বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের প্রয়োজন হয়নি। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এই সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মে এই সেতুতে কোনো টোল আরোপের সুযোগ না থাকলেও বিগত ২০০৫ সালের জোট সরকারের আমল থেকে আওয়ামীলীগ সরকারের আমল পযর্ন্ত প্রায় ১৯ বছর টোল আদায় করা হয়।
যৌক্তিক ভাবে টোলমুক্ত সেতু হলেও রাষ্ট্রীয় জটিলতায় মুক্ত হয়নি এই সেতুর টোল। অবশেষে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যেমে ২য় বারের মতো টোলমুক্ত হলো এই সেতুটি। তৈলারদ্বীপ সেতুর ইজারাদার কর্তৃক অতিরিক্ত টোল আদায় করার অভিযোগের সংবাদ সংবাদ মাধ্যমে বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তৈলারদ্বীপ সেতুতে চাঁদাবাজি বন্ধ ও টোল প্রত্যাহারের দাবিতে একাধিক বার মানববন্ধন ও বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেন সচেতন নাগরিকগণ। যাহা সড়ক জনপথ ও সেতু বিভাগ সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর মোটেও আমলে নেননি।
তৈলারদ্বীপ সেতুর টোলমুক্ত করার দাবীতে বাঁশখালী অটোরিকশা (সিএনজি) পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, রেজিঃ নং চট্ট-২৩৭৩ এর ব্যানারে বিগত ২০১৬ সালে আন্দোলন শুরু হয়, এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শ্রমিক ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ আনছার ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হাছান। এই আন্দোলনে সমগ্র বাঁশখালীর সিএনজি আটোরিক্শা শ্রমিকরা অংশ গ্রহন করেন। তারা কয়েকবার মানবন্ধন করার পর বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও সেতুমন্ত্রী সহ বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রেরণ করেন।
এদিকে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সাবেক এমপি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী’র করা রিটের প্রেক্ষিতে আদালত ২০১৭-১৮ সালের জন্য সেতুটির ইজারা প্রদান প্রক্রিয়াসহ সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছেন মাননীয় হাইকোর্ট। এরপর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, মাননীয় হাইকোর্টের বিচারপতি নাঈমা হায়দার এবং এ.টি.এম সাইদুর রহমানের বেঞ্চে ওই আদেশ দেন। জনগণের পক্ষে দায়ের করা রিট মামলা পরিচালনা করেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল (বর্তমান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা) এ.এফ হাসান আরিফ। হাইকোর্টের এই আদেশ দেওয়ার পর এই সেতুর প্রায় এক মাস টোল আদায় বন্ধ ছিলো। এরপর ২০১৮ সালের ২রা জানুয়ারি পত্রিকায় তৈলারদ্বীপ সেতুর পুনরায় ইজারার জন্য দরপত্র দেন সড়ক জনপথ ও সেতু বিভাগ (দোহাজারী)। পুনঃরায় ইজারা দেওয়ায় আবারও শুরু হয় টোল আদায় করা।
বাংলাদেশ গ্যাজেট ২৬ জুন ২০১৪ এর সংশোধিত প্রজ্ঞাপন, টোল নীতিমালা অনুযায়ী, ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অনুন্নত আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনার প্রেক্ষিতে টোল মওকুফের বিধান থাকলেও এই সেতুর ক্ষেত্রে তা স¤পূর্ণ ব্যতিক্রম ছিল। একটি সেতুতে টোল আদায় করা হয়; সেতুর নির্মাণ ব্যয় এবং রক্ষণা বেক্ষণের জন্য। সেই বিবেচনায় দেখা যায়, তৈলারদ্বীপ সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩২ কোটি টাকা। কিন্তু, প্রতি ৩ বছরে এই সেতু থেকে টোল আদায় হয় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা। অথচ’ সেতু নির্মাণের পর থেকে কোনো ধরনের দৃশ্যমান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ চোখে পড়েনি।
একই সাঙ্গু নদীর ওপর আরও ৬টি সেতু রয়েছে যা তৈলারদ্বীপ সেতুর অপেক্ষা অনেক বড়। কিন্তু বাকি ৫টি সেতু টোলমুক্ত হলেও একমাত্র তৈলারদ্বীপ সেতুতে টোল দিতে হয়, যা মানুষের সাথে চরম অমানবিক আচরণ বলে দাবী করে বিভিন্ন মহল। তৈলারদ্বীপ সেতুতে শাহ আমানত সেতুর সমপরিমাণ কিংবা তার চেয়েও বেশি টোল দিতে হয় বলছেন চলাচলকারীরা। চট্টগ্রাম শহর হতে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে তৈলারদ্বীপ সেতু অবস্থিত। একই হারে দুটি সেতুতে টোলের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা বরাবরের মতোই নিরুৎসাহিত হচ্ছে। সেতুর টোলের কারণে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ টোল নীতিমালা ২০১৪-এ টোল প্লাজার কথা উল্লেখ রয়েছে। টোল আদায়ের জন্য টোল স্থাপনা সরঞ্জামাদী, সফটওয়্যার, ও আইটি যন্ত্রপাতি ইত্যাদির কথা উল্লেখ থাকলেও তৈলারদ্বীপ সেতুতে তা অনুপস্থিত রয়েছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে টোল আদায় করা হয় এই সেতুতে। এই কারণে দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে প্রায় সময়। যানজটের কারণে বিভিন্ন সময়ে এই স্থানে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাঁশখালীর আপামর জনসাধারণের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্ঠা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর কাছে তৈলারদ্বীপ সেতুর এই অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক টোল প্রত্যাহার করার জন্য আহ্ববান জানান সচেতন নাগরিক সামাজ।
লেখক: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাঁশখালী প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]