তৃপ্তিতে ভরে উঠে মন

::
প্রকাশ: ২ years ago

অনলাইনে পেপার পড়ছি। হঠাৎ ছোট ছেলে জিজ্ঞেস করে ‘বাবা’ তোমার বয়স কত? শোনেও না শুনার ভান করি। আবারও বলে ‘বাবা’ তোমার বয়স কত? ছেলের এমন প্রশ্নে কান না দেওয়ায় এক সময় রাগ করে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর মনে হলো ছেলে বয়স জানতে চাচ্ছে কেন? একটু চিন্তায় পরে গেলাম। আমি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি? চেহারায় কি বয়সের ছাপ পরে গেছে? নানা ভাবনা মনে ঘুরপাক খায়।

সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময় যায় মুহূর্তের মধ্যে, আর স্রোত যায় নদীর প্রবাহের আলোড়নের মধ্যে। এ দুটি জিনিস নিজের ইচ্ছামতো চলতে থাকে। মানুষ চাইলেও তা আটকাতে পারে না। জন্ম নিলে মরতে হবে। শিশু একদিন বৃদ্ধ হবে। এটি আটকানোর ক্ষমতা কারো নাই। যা চিরন্তন সত্য।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। শুনেছি বয়স বাড়তে থাকলে শরীরে রোগ দানা বাঁধে। তাই বয়সের হিসাব কষতে লাগলাম, বয়স কত হলো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষে সরকারি চাকরির প্রত্যাশায় বয়স নিয়ে যোগ-বিয়োগ করতাম। ত্রিশ পার হওয়ার পর আর এ নিয়ে ভাবেনি। কখন যে জীবনের তিন যুগ পেরিয়ে চার যুগে পদাপর্ণের কাছাকাছি চলে এসেছি, তা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি।

স্মৃতির ভাবনায় ভেসে ওঠে নানা রঙের দিনগুলো। ছোটবেলার খেলার সাথীদের সাথে কানা-মাছি, লুকোচুরি, ইচিং-বিচিং, ওপেনটি বায়োস্কোপ, কুতকুত, সাতচারা, ডাংগুটি, ঘুড়ি উড়ানো, চোর-পুলিশ, চড়–ই-ভাতি, বৌ-চি আরও কতখেলা। এছাড়াও স্কুল ও কলেজ জীবনের মধুময় স্মৃতি।

জীবিকার তাগিদে একটি কর্মের জন্য একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে লাগলাম। কয়েকটিতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মৌখিক পরীক্ষায় নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। যাই হোক, সরকারি চাকরির আশা বাদ দিয়ে বেসরকারি চাকরির চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশ্য বলে রাখা ভালো, জীবনে একটিমাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছি।

আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দুটোতেই উত্তীর্ণ হলাম। চাকরিটাও হয়ে গেল। নিয়োগ কমিটি আমাকে সাভারে সোস্যাল আপলিফটমেন্ট সোসাইটি (সাস) এনজিও-তে যোগদান করতে বলেন।

তবে, একজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে অকৃতজ্ঞ থেকে যাব। তিনি হলেন কৃষিবিদ মো: রফিকুল ইসলাম ঠান্ডু মোল্লা। সম্পর্কে আমার মামা, মায়ের খালাতো ভাই। যিনি এই চাকরি পেতে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর সম্পর্কে দুই একটি কথা না বললেই নয়, তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছিলেন। ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল সুস্থ ধারার রাজনীতি করতেন। শেরেবাংলা কৃষি কলেজ (বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জিএস ছিলেন। ছিলেন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) এর সাবেক মহাসচিব। এছাড়াও তিনি নিবেদিত প্রাণ একজন সমাজসেবক।

জীবনে প্রথম চাকরি। মনে বেশ আনন্দ। আবার পরিবার ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, বন্ধুদের ছেড়ে থাকা পরক্ষণেই মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। জীবন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। অবশেষে যোগদান করলাম। দিনটি ছিল ২০০০ সালের পহেলা জুলাই।

জীবনের প্রায় চার যুগের দুই যুগ সাস এ চলছে। এই দুই যুগে প্রতিষ্ঠানটি আমাকে কী দিয়েছে, আমিই বা কী দিয়েছি? দেওয়া না দেওয়ার হিসাব কষতে কষতে মনটা দারুণ এক প্রশান্তিতে ভরে গিয়ে বিশাল সমুদ্রের চেয়ে কয়েক গুণ বড় হয়ে গেল। সাস এ চাকরি জীবনে আমি যে সম্মান পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি কোটি টাকার সম্পদ, প্রতিপত্তি অর্জন করেও অনেকে তা পায় না।

প্রশিকার ড্রিসাফ প্রল্পের অর্থায়নে সাভারে শিশুদের জন্য সাস উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতো। শিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং ও রিপোর্টিংয়ের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর।

সাস এর বর্তমান পরিচালক কৃষিবিদ মো. রফিকুল ইসলাম মোল্লা সরকারি চাকরি করতেন। আমি যোগদানের কিছুদিন পর তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে সাস -এ যোগদান করেন। তিনি যোগদানের পর আমার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়।

সাভারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে। তাদের মধ্যে বেদেসম্প্রদায় অন্যতম। এই সম্প্রদায়কে সমাজের মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সবসময় চিন্তা-ভাবনা করতেন। ওই সময়ে বেদেদের গুটি কয়েক পরিবার বাদে অধিকাংশ পরিবারের সন্তানরা স্কুলে যেত না। সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর তেমন কোনো আগ্রহও অভিভাবকদের ছিল না। বেদে সন্তানদের স্কুলমুখী করতে সাস প্রশিকার ড্রিসাফ প্রকল্পের অর্থায়নে বেদেপাড়ায় একটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র (ইউসুফ ভাইয়ের বাড়িতে) চালু করে। শিক্ষাকেন্দ্রটিতে পাঠদানের জন্য একজন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বেদেপাড়ায় শিশুদের পড়ানোর জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। অবশেষে আড়াপাড়ায় একজন মহিলার খোঁজ পাওয়া গেল। নাম ফাতেমা হোসেন, স্বামী প্রথম শ্রেণির একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বেদেপাড়ার শিক্ষাকেন্দ্রটির শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক। মাসিক সম্মানী ছয়শত টাকা। উনি বললেন, টাকার জন্য নয়, সম্মানের জন্য আমি শিক্ষকতা করব।

২০০০ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রটি চালু হলো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিশুদের ভর্তি করানো হলো। এক সময়  কেন্দ্রটি চাঁদের মতো ফুটফুটে বিশ, বাইশজন শিশুর পদচারণায় ভরে গেল। তাদের আসা-যাওয়া ও হৈ-হৈল্লোরে শিক্ষাকেন্দ্রটি মুখরিত হয়ে ওঠে।

শিক্ষাকেন্দ্রটিতে ছাত্রছাত্রীরা কিছুদিন নিয়মিত আসলেও কয়েকদিন পর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমতে লাগলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, না আসা শিশুরা তাদের পরিবারের সাথে গাওয়ালে চলে গেছে। যে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়মিত আসে তাদের মধ্য্যে সায়েরুল, ফরহাদ ও বর্ষা অন্যতম। পড়ালেখার প্রতি ওদের বেশ আগ্রহ। ওদের আগ্রহ দেখে আমার মনে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো। ভাবতে লাগলাম আর কিছু পারি আর নাই পারি যেভাবেই হোক ওদেরকে নিরক্ষরমুক্ত করে সাক্ষরতা শিখাবো। যাতে ওরা লিখতে, পড়তে ও গণনা করতে পারে। অন্য যে কোনো কেন্দ্রের  চেয়ে এই কেন্দ্রটিতে আমি একটু বেশি সময় দিতাম। ফাতেমা আপা ঝড়-বৃষ্টিতেও কখনো কেন্দ্রটিতে অনুপস্থিত থাকেননি। নিয়মিত মাতৃস্নেহে পাঠদান করিয়েছেন।

হাটি হাটি পায়ে শিক্ষাকেন্দ্রে আসা বেদেপল্লির ফুটফুটে সেই শিশু ছাত্র মো. সায়েরুল ইসলাম মাস্টার্স, মো. ফরহাদুল ইসলাম অনার্স শেষ করেছে আর ছোট্ট মেয়ে বর্ষা অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ে। ওদের সাথে দেখা হলে সম্মানের সাথে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে, কেউ আবার ফোন করে খোঁজ-খবর নেয়। ওদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তৃপ্তিতে ভরে উঠে মন।

লেখক: মো. নবী আলম, সাংবাদিক।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net