তুমুল জনপ্রিয় এফএম রেডিও স্টেশনগুলোর যেভাবে পতন হলো

::
প্রকাশ: ২ years ago

সংস্কৃতি ডেস্ক: 
মোটামুটিভাবে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল– এফএম রেডিওর স্বর্ণযুগ। এটা এমন একটা সময় ছিল, যখন ঢাকাবাসীর কানে দেখা যেত হেডফোন। কাজ করতে করতে, পথ চলতে চলতে রেডিও শুনছেন তারা। তখন নতুন গানগুলো প্রথমে রেডিওতেই মুক্তি পেত। হাজার হাজার শ্রোতা ম্যাসেজ করে অনুরোধ করতেন তাদের প্রিয় গান বাজানোর। সে সময়ে এতটাই এফএম রেডিওর জয়জয়কার ছিল, যে মানুষ তাদের গাড়ির সিডি প্লেয়ারের জায়গায় রেডিও বসিয়ে নিত। আর উন্মাদনার কেন্দ্রে ছিলেন আরজে’রা (রেডিও জকি)।

এমন এক জনপ্রিয় রেডিও জকি ছিলেন আরজে সায়েম। তার ফ্যানবেইজও ছিল বেশ বড়। একবার তার সিলেটের ভক্তরা একটি ফ্যান ক্লাব খুলে বসে এবং তাকে অনুরোধ জানায় সেটির উদ্বোধন করার। সিলেটে যাওয়ার টিকেট থেকে শুরু করে হোটেল ঠিক করা পর্যন্ত ভালোবেসে পুরোটাই করে দেয় তার ভক্তরা। আর সেখানে গিয়ে এত এত উপহার পান, যে সেগুলো আনার জন্য আরেকজনের সাহায্য নিতে হয়েছিল।

সেই সোনালী দিনের রেডিও জকিদের ঝুলিতে আছে– তাদের ভক্তদের সাথে অনেক মজার গল্প; যা তারা স্মৃতির ভাণ্ডারে রেখেছেন পরম যত্নে।

কিন্তু, ঢাকার এফএম রেডিওগুলি ফেলে এসেছে সে সোনালী সময়। সেই রঙিন দিনগুলো যেন অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।

রেডিও যে একেবারেই নেই- তা নয়। এখনো অনেক এফএম রেডিও চালু আছে, তবে আগের মতো আর সেগুলো মানুষের কথোপোকথনের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই, যেমনটি আগে ছিল। এর পেছনে অনেক কারণ আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত রেডিওর প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ কমে গেছে। আর ঘণ্টাপ্রতি বিজ্ঞাপনের সময় ২০ মিনিট থেকে গড়ে পাঁচ মিনিটে নেমে আসায় কমেছে আয়। (অর্থাৎ রেডিও স্টেশনগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে স্লটগুলো ঘণ্টাপ্রতি মাত্র পাঁচ মিনিট পূরণ করতেও হিমশিম খায়)।

তাছাড়া, প্রোগ্রামগুলো এখন টাইটেল স্পন্সর ছাড়াই চালাতে হয়– যেখানে আগেকার দিনে স্পন্সরদের লম্বা সারি লেগে যেত।

আরজে সায়েম রেডিও ক্যাপিটাল-এর হেড অভ অপারেশন্সের পদ থেকে অবসরের মাধ্যমে এই ইন্ডাস্ট্রি ছাড়েন। তিনি বলেন, ‘সেলিব্রেটি থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই রেডিও নিয়ে কথা বলত। কিন্তু, এখন আর কেউ কথা বলে না। এখন রেডিও আদৌ কেউ শোনে কিনা- তা নিয়েও আমার সন্দেহ হয়।’

রেডিও টুডে এবং রেডিও ফ্রুটিতে কাজ করার সময়ে সায়েমের ক্যারিয়ার ছিল তুঙ্গে।

তিনি আরও বলেন, ‘মিডিয়ায় কাজ শুরু করার ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম ছিল রেডিও। বিনিয়োগ, বিজ্ঞাপনের জন্য এটি ছিল অসামান্য এক গন্তব্য, এবং শ্রোতাদের কাছেও ছিল বড় কিছু।’

‘আমার মনে হয় এই ইন্ডাস্ট্রিতে সেই সময়টাই (২০০৮ থেকে ২০১৩) আমার সবচেয়ে ভালো সময় ছিল। এটি রেডিওর জন্যেও আনন্দময় একটা সময় ছিল। কিন্তু, তার পরেই রেডিওর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। এবং এরপর রেডিওর পতন একেবারে আকস্মিকভাবে এসে যায়।’

 

অর্থের সংকট
পরবর্তীতে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হওয়ার প্রবণতার যে জোয়ার এসেছিল, রেডিওর ক্ষেত্রেও শুরুতে তেমনটা ছিল।

একটা সময়ে ২০টির বেশি এফএম রেডিও স্টেশন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু, পরে আরও নতুন নতুন চ্যানেল আসায়– রেডিও স্টেশনগুলো আরও অধিক শ্রোতা তৈরির পরিবর্তে উল্টো নিজেদের জায়গা হারাতে শুরু করে।

ইউটিউব, ফেইসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম এসে একে একে বিনোদনের সেই জগত কেড়ে নেয়– যা এতদিন ছিল রেডিওর দখলে। শ্রোতা কমে যাওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারা মুখ ঘোরাতে শুরু করল, ফলে কমে গেল টাকা। রেডিও স্টেশনগুলো প্রত্যাশিত বেতন দিতে না পারায় দক্ষ এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আরজেরা অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যেতে শুরু করল, আর সেই সাথে কমতে শুরু করল অনুষ্ঠানগুলোর মান।

এবিসি রেডিওর নির্বাহী প্রযোজক সাগর শাহরিয়ার বলেন, ‘১২ ঘণ্টার একটি সম্প্রচারে আমাদের দুই ঘণ্টার বেশি বিজ্ঞাপন থাকত। এখন থাকে মাত্র ২৭ মিনিটের মতো।’

তিনি বলেন, ‘মূলত সমস্যাটি হলো আমরা অনেক বেশি ডিজিটালে পরিণত হয়েছি। বাস্তবতা হলো- বাড়িতেও কেউ আসলে টেলিভিশন দেখছে না। কি,ন্তু তবুও কোম্পানিগুলো টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে চায়।’

‘যাদের সাথেই আমি কথা বলি, তারা সবাই বলে ‘আমাদের এখন বিজ্ঞাপন দেওয়ার বাজেট নেই, আগে বাজেট তৈরি করে নিই।’ আরেকটা সমস্যা হলো আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে বিজ্ঞাপন নিতে হয়। তারাও টাকার একটা অংশ কেটে রাখে। আবার অনেক এজেন্সির নিজেদেরই রেডিও চ্যানেল থাকে। তারা আমাদের বিজ্ঞাপন দিতে অনাগ্রহী,’ যোগ করেন শাহরিয়ার।

 

দৃশ্যপটের বাইরে
বিজ্ঞাপনী আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রেডিওর পতনের আরও তিনটি কারণ উল্লেখ করেন সায়েম।

তিনি বলেন, ‘লোকবলের বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই তো লেখে, কিন্তু সবাই তো আর সাংবাদিক নন। ঠিক এটাই হয়েছে রেডিওর ক্ষেত্রে। রেডিও স্টেশন অনেক আছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নেই।’

অনেক বেশি রেডিও চ্যানেল চালু হওয়ায়, দক্ষ আরজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

‘আমি বলছি না যে আমরাই সবচেয়ে ভালো আরজে ছিলাম; কিন্তু আমরা কঠোরভাবে চেষ্টা করতাম। ভারতীয় প্রশিক্ষকের কাছ থেকে আমরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। নিজেদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছি। রেডিও-ই ছিল আমাদের সব, তাই নিজেদের সবটুকুই দিয়েছিলাম রেডিওকে। আর এখন অনেকগুলো অপশন আছে- যা সবাই ব্যবহার করছে। আমরা তা করিনি’, যোগ করেন সায়েম। দ্বিতীয়ত, আছে সৃজনশীলতার অভাব।

সায়েম বলেন, ‘রেডিও একটি সৃজনশীল ক্ষেত্র। ব্যবসায়কে সৃজনশীলতার পরিধির মধ্যে আনতে হবে। যদি মনে করেন- এটি কেবল ব্যবসা; এখানে কোনো সৃজনশীলতার বালাই নেই- তাহলে কিন্তু হবে না।’

চ্যানেলগুলোর একে অন্যকে নকল করার প্রবণতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে হয়েছিল কী যে একটা স্টেশন একটা অনুষ্ঠান শুরু করে; আরেক স্টেশন সেই একই অনুষ্ঠান শুরু করে, তারা নকল করতে শুরু করে। ফলে নতুন কোনো কন্টেন্ট বা আইডিয়া আসে না। এর ফলে মান কমতে থাকে।’

এবং তৃতীয়ত, সায়েম, আরজে নীরব, আরজে রাসেল এবং মারিয়া নূরের মতো জনপ্রিয় আরজেরা রেডিওতে কাজ বন্ধ করে দেয় অথবা টেলিভিশনে চলে যায়।

সায়েম বলেন, ‘রেডিও মিরচি যেভাবে মীরকে (আফসার আলী) অথবা মীর যেভাবে রেডিও মিরচিকে ধরে রেখেছিল– এফএম রেডিওগুলো আমাদের সেভাবে ধরে রাখতে পারেনি। আর যা-ই হোক, এটাই তো আমার ক্যারিয়ার। আমাদেরও তো ভালো বেতনভাতা প্রয়োজন।’

সায়েম আরও বলেন, “সিনিয়র হয়ে গেলে অন্যান্য দেশে বেতন বাড়ে, আর আমাদের দেশের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, ‘আচ্ছা, সে সিনিয়র হয়ে গেছে, তার জায়গায় আরও দুইজনকে আনো।’ রেডিও যদি আমাদের মতো চার বড় হেডদের ধরে রাখতে পারতো, সেটিও যথেষ্ট হতো। কিন্তু কেউ থাকেনি।”

 

কোনোক্রমে টিকে থাকা
আজিজ হাকিম অনেক বছর ধরে রেডিও টুডে, স্বাধীন এবং পিপল’স রেডিওতে কাজ করেছিলেন। পিক সিজনগুলোতে লাখো শ্রোতা ভূত এফএম, লাভ গুরু, রাতবড় গানের মতো অনুষ্ঠানগুলো শুনত বলে জানান তিনি।

২০১৩ সালে পর এ সফলতা বিপরীত মোড় নিতে শুরু করে।

আজিজ বলেন, ‘২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল নাগাদ রেডিওতে বিজ্ঞাপন অনেক কমে যায়, বা নেই বললেও চলে। গানের অনুরোধ বা কোনোকিছুর জন্য ম্যাসেজ আসত না, তাদের নিজেদেরই ম্যাসেজ পাঠাতে হতো। ফেইসবুকে এসে শ্রোতাদের কমেন্টের অনুরোধ জানাতে হতো। এখন কেবল খেলাধূলার ধারাভাষ্যের জন্যেই রেডিওগুলো কোনোমতে টিকে আছে।’

এফএম রেডিওগুলো এখন ফেইসবুক এবং ইউটিউবে তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে– যেটি খুব একটা সমর্থন করেন না সায়েমের মতো আরজেরা।

সায়েম একেবারে এর বিরুদ্ধে, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, ‘কত ভিউ আসলো তার থেকে জনপ্রিয়তা ভিন্ন, আরও দীর্ঘস্থায়ী।’

যদিও নতুন প্রজন্মের আরজেরা এই পরিবর্তনকে দেখেন ইতিবাচকভাবে। তারা মনে করেন, এটাও রেডিওকে বাঁচিয়ে রাখার একটি উপায়। তাদের মধ্যে একজন হলেন, রেডিও স্বাধীন-এর আরজে সাদিয়া। তার মতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে রেডিও আবার উঠে আসছে।

রেডিওর পতন যখন শুরু হয়, তখন সাদিয়া ছিলেন একজন শ্রোতা। তার মতে, যথাসময়ে ডিজিটাল বলয়ের সাথে তাল না মেলানোই এ পতনের কারণ।

তিনি বলেন, “এটা এমন ছিল যে আমরা ‘রেডিও’, যতই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আসুক না কেন আমরা কেবল অন-এয়ার ফ্রিকুয়েন্সিতে কাজ করব। আমাদের নিজেদের পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। আমি মনে করি যারা নিজেদের পরবর্তন করে তারাই সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকে। পরিবর্তন না চাইলে সেটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।’

এখন যেহেতু এফএম রেডিওগুলো ইউটিউব, ফেইসবুকের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যাপে কাজ করছে, তাই রেডিওর জনপ্রিয়তাও ধীরে ধীরে আবার বাড়ছে। রেডিওর কন্টেন্টেও এসেছে পরিবর্তন।

সাদিয়া বলেন, ‘আগে শ্রোতারা গানের অনুরোধ করত, এখন তারা আমাদের কথাগুলোই শোনে। তারা আমাদের সরাসরি সম্প্রচারিত খেলার ধারাভাষ্য শোনে। এছাড়াও, আমরা অনেক সামাজিক কার্যক্রম করে থাকি। যেমন, আমরা নারী দিবস পালন করি। এবং নারীর অধিকার ও মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানান বিষয়ে আলোকপাত করি।’

‘যেহেতু এর পরিধি ফেইসবুকে স্থানান্তরিত হয়েছে, সেহেতু আমরা আর আগের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কথা বলতে পারি না; কিংবা বিরতির সময় গান বাজাতে পারি না। তার পরিবর্তে আমরা ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য সরাসরি সম্প্রচারে যাই, শো-এর বিষয় নিয়ে এবং শ্রোতাদের সাথে কথা বলি। অনেকটা যা বন্ধুদের সাথে সাক্ষাতের মতো। তারা আমাকে দেখে , কথা বলে, ব্যাপারটা আমার বেশ প্রাণবন্ত মনে হয়’, যোগ করেন তিনি।

 

সৌজন্য: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড