তামিমের অবসর ও প্রত্যাহারের পোস্টমর্টেম চাই

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

ক্লাসের সবাই যদি একে একে অংকে ফেল করতে থাকে, তখন আঙ্গুলটা কি ছাত্রদের দিকে দেয়া ঠিক হবে? দেশের ক্রিকেট বোর্ড ভেতরে ভেতরে কতটা ঘুনেধরা হলে, কতটা বিপর্যস্ত হলে, সিনিয়র প্লেয়ার এবং ম্যানেজমেন্টের মাঝে কতটা দূরত্ব সৃষ্টি হলে স্বয়ং একটি দেশের প্রাইম মিনিস্টারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তামিম যে প্রথম তা নয়। এর আগেও দু-তিনজন সিনিয়র প্লেয়ারের বেলায় একই ঘটনা ঘটেছে। প্রমাণ হলো, তামিমের ওই কান্না তার একার ছিলো না। সে কান্না ছিলো, লাখো ক্রিকেটপ্রেমিদের কান্না।
আসলেই কি তামিম চালিয়ে যেতে পারছিলেন না? নাকি কোনো চাপ তাকে বাধ্য করেছে! আমরা এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছি। আমরা তামিমের অবসর ঘোষণা ও পরবর্তীতে প্রত্যাহার ডিক্লারেশনের পোস্টমর্টেম চাই। তামিম বাংলাদেশের ক্রিকেটকে যা কিছু দিয়েছে, তা এ দেশের ক্রিকেট প্রেমিরা আজীবন মনে রাখবে। একজন তামিম হয়ে উঠতে কত শ্রম, কত সময়, কত মেধা আর কত ত্যাগ থাকতে হয়, তা বিসিবির বুঝতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পরে অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছেন তামিম ইকবাল। তবে আপাতত দেড় মাসের বিশ্রামের পর এশিয়া কাপে ফিরবেন তামিম। খুব ভালো সিদ্ধান্ত। আমরা তামিমের ফিরে আসাকে স্বাগত জানাই। ধন্যবাদ জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে, ধন্যবাদ কিংবদন্তি মাশরাফি বিন মুর্তজাকে, ধন্যবাদ তামিম ইকবালকে।
মাশরাফি, মুশফিক, রিয়াদ অতিসয় ভদ্রলোক বলে পার পেয়ে গেলেও এক যায়গায় সংশ্লিষ্টদের ‘কট’ খেতে হলো। কারণ কোন কোন খেলোয়াড় কাউকে গোনায় ধরেন না! এটা ভেবে ভাল লাগছে, বিসিবির অধিকাংশ কর্মকর্তাদের আÍসম্মানবোধ না থাকলেও তামিমের আছে! তামিমের ভয়ডরহীন খেলা, স্মার্ট ইংরেজি বলা, কেতাদুরস্ত চলাফেরা, সর্বোপরি উঁচু মাত্রার আÍসম্মানবোধকে ক্রিকেটপ্রেমিরা মনে রাখবে ও সম্মান করবে। খেলোয়াড়দেরকে মানসিক চাপে রেখে বিসিবি ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে পারবে না। তামিম, মাশরাফি, রিয়াদের মতো লিজেন্ডরা যখন একইভাবে অপমানিত হয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হন, তখন বুঝতে হবে কোথাও কোন সমস্যা আছে।
বাংলাদেশের হয়ে ১৫ হাজারের বেশি আন্তর্জাতিক রানসহ জীবন্ত কিংবদন্তি তামিম ইকবালকে এমন কান্নাভেজা বিদায়ের ঘোষণা দিতে হবে! ভর্ৎসনা, অপমান তাকে এই কা- ঘটাতে বাধ্য করেছে। তাকে কোনো আমরা ফুল দিয়ে বীরের বেশে বিদায় জানাব না! সামনের বিশ্বকাপে খেলাতো বটেই। আরও অনেক কিছু দেয়ার সামর্থ্য তামিমের রয়েছে। তামিম যখন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সাংবাদিক সম্মেলন করলেন, সাংবাদিকেরা বুঝে গিয়েছিলেন তামিম ক্রিকেট হতে অবসর নিতে যাচ্ছেন, যা প্রতিটি সংবাদপত্রে ফলাও করে লেখা হয়েছে। শুধুু জানতে পারেনি ক্রিকেট বোর্ডের মহাশক্তিধর! ব্যক্তিবর্গগণ।
বাংলাদেশের লিজেন্ড ক্রিকেট খেলোয়াড়রা প্রেস কনফারেন্স ডেকে, অশ্র’শিক্ত নয়নে অভিমান করে চলে যাচ্ছেন, এটা বারবার কেন হচ্ছে? গণমাধ্যমে যা দেখা যায়, তা থেকে বিচার করলে বলতেই হয়, বোর্ড প্রফেশনালি খেলোয়াড়দের হ্যান্ডেল করতে পারছে না। ইঞ্জুরি সংক্রান্ত ডিলিংসগুলো নিয়ে মন্তব্যগুলো ঠিক নয়। প্লেয়ারদের ছোটখাট ইঞ্জুরি থাকতেই পারে, সেসব ঘটা করে বলার কিছু নেই। একজন বোর্ড সভাপতি দলের ভিতরের বিষয়গুলো ইচ্ছেমতো প্রেসে বলে বেড়াতে পারেন না। যখন কর্তাব্যক্তিদের মুখে কোন কথা আটকায় না, ক্রিকেটারদের সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারেন না, তখন তামিমদের আর কিছু করার থাকে না। আবেগ-ভালোবাসা, স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, সব বিসর্জন দিয়ে, অভিমানে ক্রিকেটকে বিদায় বলতেই হয়। একেকজন লিজেন্ডস ক্রিকেটার অসময়ে, অভিমানে, অসম্মান বোধে বিদায় নিচ্ছে, অথচ যিনি তাদের মনোবেদনা বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না! কেমন অভিভাবক তিনি?
ইতিহাসের সাক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে কোন সিনিয়র খেলোয়াড়ই সš§ান নিয়ে বিদায় নিতে পারেননি। যখন সিনিয়র খেলোয়াড়েরা বুঝতে পারছেন, তাদেরকে বোর্ড কিংবা কোচকর্তৃক অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, তখন তারা নিজেদের আÍসম্মানবোধ থেকেই নিজ থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন হয়তো।
গ্যালারি ভরা ভক্ত-সমর্থকদের করতালি, সতীর্থ-প্রতিপক্ষ আর প্রিয়জনদের উষ্ণ আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে মাঠের খেলোয়াড়ের মাঠ ছেড়ে যাওয়া, কী হƒদয়স্পর্শী একটা ব্যাপার! পরিতাপের বিষয় হল, আমাদের খেলোয়াড়দের কপালে কেন জানি সে আবেগঘন ‘বিদায়’ জোটে না। আমাদের এখানে বিদায় মানে একেবারে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়ার মতো ঘটনা। মাশরাফি থেকে তামিম, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি; নিদারুণ পীড়াদায়ক। একজন খেলোয়াড় যেমন দেশের প্রতিনিধিত্ব করে তেমনি রাষ্ট্র যাদের খেলোয়াড় তৈরি ও পরিচালনার দায়িত্ব দেন, তাদের যোগ্য ও সৎ হওয়া কতটা জরুরি সে বিষয় নিয়ে আমাদের তেমন কোন মাথাব্যথা আছে কী?
তামিম আমাদের গর্ব, অহংকার। সে একজন রোল মডেল, সে একজন আন্তর্জাতিক তারকা, সে ব্র্যান্ড, একজন এভার বেস্ট পারফর্মার, একজন এমবাসেডর… এমন অনেক কিছু। বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন লিজেন্ড, সত্যিকার আইকন। যিনি ক্রিকেটকে অনেক দিয়েছেন। বাংলাদেশকে অসংখ্যবার জয়ের গৌরব এনে দিয়েছেন তামিম।
ক্রিকেটের তীর্থ ‘লর্ডস’ ক্রিকেট গ্রাউন্ড। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সব ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন থাকে লর্ডসে যদি একটা ম্যাচ খেলতে পারতাম! সেদিক থেকে তামিম ইকবালকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। লর্ডসে তিনটি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সব সংস্করণেই একটি করে। ২০১০ সালে লর্ডসে খেলা টেস্টটিতে ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় একটি ইনিংস খেলেন তামিম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৫৫ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন সেঞ্চুরি। এতে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম উঠে তামিমের। যেখানে নাম তুলতে পারেননি কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারও। সেঞ্চুরি করলে বা বল হাতে ৫ উইকেট পেলেই লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম ওঠে কারও। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ও সফলতম ওপেনার তামিম, সেই তামিম কাঁদলেন, চোখ মুছে ফের কথা শুরু করলেন, খানিক বাদে আবার অশ্রু ঝরতে থাকলো, এভাবেই তামিমের মতো একজন কিংবদন্তির বিদায় ঘোষণা এবং অন্য কারো বেলায় এমন ঘটনার পুণরাবৃত্তি হতে পারে না।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যা শুরু হয়েছে না, নাটক, আর ভালো লাগে না। অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম।’ আসলে নাটক কে/কারা করছে, বিসিবি না প্লেয়াররা? মানসিক চাপে রিয়াদ অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন, মুশফিককে ক্যাপটেনসি থেকে সরানো হয়। কোন খেলোয়াড়ই গায়ের জোরে জেঁকে বসে থাকার নয়। বিসিবিতে কতিপয় কর্মকর্তা আছেন যাদের এ্যটিচ্যুয়েট সম্পূর্ণই ক্রিকেট বহির্ভূত, একগুঁয়ে, গোয়ার টাইপের। তাদের কথাবার্তা বডি ল্যাংগুয়েজ অহংকারী হামবড়া ভাব। খেলোয়াড়দের সাথে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করাই যেন তাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাছে ক্রিকেট মানে তামিম, সাকিবদের দিয়ে তৈরি হওয়া ব্রান্ড ভেলু ব্যবহার করে দেশ বিদেশ সদলবলে ঘুরে বেড়ানো। বিসিবির বুঝতে হবে, ক্রিকেট তাদের বাপ-দাদার জমিদারি, আর ক্রিকেটাররা তাদের ফ্যাক্টরির কারিগর নয়।
এক সময় ওপেনিং জুটি দাঁড়াতেই পারতোনা কিন্তু তামিম ইকবাল আসার পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যাপক উন্নতি হয় এবং বিশ্বের মধ্যে একটি সমীহ জাগানিয়া দল হয়। তামিম ইকবাল ওপেনিংয়ে ভালো করতো আর মুশফিক, সাকিবরা সেই ইনিংস টেনে নিতো। মোটকথা, ভালোবাসার এক ওপেনার তামিম। বহুবার আমরা এমন দেখেছি, তামিমের ব্যাট কথা বললে টীম টাইগাররা জ্বলে ওঠে, তামিম ফ্লপ তো জাতীয় দল দাঁড়াতে পারে না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সোনালী প্রজšে§র একজন সারথি তামিম। বাংলাদেশের মানুষের অনেক আনন্দঘন মূহুর্ত উপহার দিয়েছেন তামিম।
পক্ষপাতিত্ব আম্পায়ারিং, কোনো দলকে বিশেষ সুবিধা দেয়া এটা বাংলাদেশের ঘরোয়া লীগের নিয়মিত চিত্র। গত ২০২১ সালের ১১ জুন প্রিমিয়ার লীগের আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মেজাজ হারান সাকিব আল হাসান। মাঠেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। মুশফিকুর রহিমের এলবিডব্লিউর আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দেয়ায় ক্ষুব্ধ সাকিব আল হাসান লাথি মেরে স্ট্যাম্প ভেঙে দেন। এরপর আম্পায়ার গ্রাউন্ডসম্যানদের পিচকাভার আনতে বললে রাগে ফুঁসে উঠলেন সাকিব। এবার হাত দিয়ে স্ট্যাম্প তুলে ছুড়ে ফেলেন মাঠে। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাকিবের আচরণ সমর্থন করতে না পারলেও এটা যে বিশাল অর্গানাইজড ক্রাইম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ব্যাপক সমর্থন দেখা গেছে।
কোনো কিছুতে লাথি দেয়ার স্বপক্ষে কথা বলা উচিত নয়; কিন্তু সাহসী সাকিবের সে লাথি অন্যায়ের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে থাকবে। এ লাথিমারা একদিনে আসেনি, অনেক জমানো ব্যাথার বহিঃপ্রকাশ। বিদ্রোহ কখনো নিয়ম মেনে হয় না। ভদ্রতা ও বিদ্রোহ এ দুটি এক জিনিস নয়। বিদ্রোহের ভাষা আর দালালির ভাষা, কখনো এক হতে পারে না। সাকিব আল হাসান বিদ্রোহ করেছেন। অন্যায় করা যখন কোন অপরাধ নয়, তখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করা অপরাধ হয় কী করে? আমরা দেখছি সাকিবের দেয়া লাথি শুধু স্ট্যাম্পে লাগেনি। লীগ সংশ্লিষ্ট অনেকের গায়েও লেগেছিলো হয়তো। সেদিন সাকিব লাথি স্ট্যাম্পে মারেনি; বরং লাথি মেরেছিলেন দুর্নীতিবাজ অদৃশ্য দানবের মুখে। সাকিবের লাথি ক্রিকেটের বিরুদ্ধে ছিলো না, সে লাথি ছিলো চলমান অন্যায়ের বিরুদ্ধে…।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে আগামীতে সময় করে সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক ও রিয়াদকে নিয়ে বসা এবং বিসিবির অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো তাদের কাছ থেকে জানা ও স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা। তা না হলে কিছুদিন পরপর এমন পরিস্থিতি ক্রিকেট দল এবং সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করছে।