ঢাকার বাতাসে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কণা

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন রিপোর্ট
প্রকাশ: ২ years ago

ধীরে ধীরে বিপজ্জনক অবস্থায় যাচ্ছে ঢাকার বায়ু। দূষিত বস্তুকণার পর এবার ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব মিলেছে। যা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানবদেহে। এক গবেষণায় এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এটি ওষুধেও দ্রুত সারবে না।

ঢাকার বিষাক্ত বাতাসের বস্তুকণার পাশাপাশি, অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন ও টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায়। একটি বিশেষ যন্ত্র বসিয়ে ঢাকার ১৩টি এলাকা এবং গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বাতাসের ধুলা আর উড়ন্ত ধুলার ছবি তুলে এই গবেষণা করা হয়। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, বাংলাদেশে তৈরি হওয়া বর্জ্যের ৬০ শতাংশ ঘরের আশপাশে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ওই ধোঁয়া থেকে কার্বন মনোক্সাইড, মার্কারি, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন তৈরি হয়। যা ঢাকার বাতাসকে মারাত্মকভাবে বিষাক্ত করছে। এছাড়াও অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে নদী ও সমুদ্রের মাছ, পানি, মাটি ও চায়ের জমিতে।

প্লাস্টিক কণা নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে প্রথমে ফুসফুস, পরে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। এতে ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসজনিত অনেক সমস্যা তৈরি করে বলে জানান জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী।

গবেষণায় বাংলাদেশের ঢাকা ও ভোলা জেলা, নেপালের ললিতপুর, লুমবিনি, কাঠমান্ডু, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন, জর্জিয়া থেকে বাতাসের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত গ্যাস পাওয়া গেছে ঢাকা শহরে।

বর্তমান সময়ে ঢাকার বাতাসকে বিপজ্জনক অভিহিত করা হচ্ছে। স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি দূষিত ঢাকার বাতাস। বিগত ৭ বছরের জানুয়ারি মাসে একদিনও নির্মল বায়ু পাওয়া যায়নি। বায়ুতে পানিবাহিত রোগের জীবাণু ছড়াচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মাসে একদিনও নির্মল বায়ু পায়নি এই শহরের মানুষ। ৩১ দিনের মধ্যে বাতাসের মান ১০ দিনই ছিল বিপজ্জনক পর্যায়ে। আর ২১ দিনই ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাতাসের মানের কোনো উন্নতি হয়নি।

এদিকে, ঢাকার বিভিন্ন সড়কে উন্নয়ন কাজ চলছে। এজন্য সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করা হচ্ছে। এতে করে সড়কে প্রচুর ধুলা ও বালুকণা তৈরি করছে। সেসব বাতাসে মিশে, পরিবেশ দূষিত করে তুলেছে। উন্নয়ন কাজের সময় সৃষ্টি হওয়া ধুলা পানি ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থাকলেও তা করা হচ্ছে না।

বিদ্যমান অবস্থায় দূষিত বায়ু গ্রহণ করে ঢাকাবাসী বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা। একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, এখন ঢাকার ৪০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারছে না। হাসপাতালগুলোতে বায়ুদূষণজনিত কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে শত শত শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

কিছু এলাকার চিত্র:
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় বর্তমানে সড়ক, ফুটপাত ও নর্দমা উন্নয়নের কাজ করছে দুই সিটি করপোরেশন। পানির নতুন পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। বিদ্যুৎ লাইনে কাজ করছে ডিপিডিসি। আর ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (এমআরটি) মেট্রোরেলের উন্নয়ন কাজ চলছে, দীর্ঘদিন ধরে চলছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কাজ, নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

সরেজমিন দেখা গেছে, বেইলি রোডের দেশের স্বনামধন্য বিদ্যালয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়ক খুঁড়ে বৈদ্যুতিক লাইনের কাজ করছে ডিপিডিসি। মন্থরগতিতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে কাজ। সড়ক খুঁড়ে মাটি ফেলে রাখায় আশপাশের এলাকা ধুলায় একাকার হয়ে রয়েছে। স্কুলগামী শিশু-কিশোররা এসব ধুলায় দূষিত বাতাস গ্রহণ করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। ওই সড়কেও কখনো পানি ছিটানো হয় না বলে জানান সড়কের আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মরতরা।

একই চিত্র, মগবাজার থেকে বাংলামোটর সড়কের। তিন মাসের বেশি সময় ধরে ওই সড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে। ফুটপাত, নর্দমা ও সড়কের উন্নয়ন কাজ করছে ডিএনসিসি। ব্যস্ততম এই সড়কে চলাচলের কোনো উপায় নেই-গাড়ি চলাচলের সময় ধুলায় একাকার হয়ে যেতে হয়। পরিষ্কার কাপড় পরে এই দূরত্ব যেতেই শরীর ও পোশাকের রঙ বদলে যাবে।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, সাতমসজিদ রোডের মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড থেকে ২৭ নম্বর মোড় পর্যন্ত অংশে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। ডিপিডিসি নিজেদের লাইন সংস্কারের জন্য ডিএনসিসির অনুমোদন সাপেক্ষে এই খোঁড়াখুঁড়ি করছে। বনানী ৯ ও ১০ নম্বর সড়ক খুঁড়ে কাজ করছে ডিপিডিসি। গুলশান-১ থেকে মহাখালী পর্যন্ত সড়কটি দীর্ঘসময় ধরে খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। কচ্ছপগতিতে চলছে কাজ। এই সড়কের কাজের কারণে প্রচুর ধুলোর সৃষ্টি হচ্ছে।

ব্যস্ততম এই সড়কে সরকারি তিতুমীর কলেজ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিস রয়েছে। এই সড়কে চলাচলকারী ও আশপাশের অফিসে কর্মরত এবং বসবাসকারীদের জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে এই সড়কটি।

ধুলা দূষণের আরও ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে আব্দুল্লাপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পে। মোটরবাইকে চলাচলকারীদের ধুলোয় একাকার হতে হচ্ছে। মিরপুর এলাকায় ডিএনসিসির ফ্লাইওভার নির্মাণ ও সড়ক উন্নয়ন কাজের কারণেও প্রচুর ধুলার সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুদূষণ ছিটাতে দেখা গেলেও তা খুব কার্যকর হচ্ছে না। আগারগাঁও সড়ক প্রশস্তকরণ কাজের কারণেও ওই এলাকায় প্রচুর ধুলার সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার পাইপলাইন নির্মাণকাজের জন্য পুরান ঢাকার জুরাইন, মতিঝিল, শনির আখড়া ও উত্তরাসহ বেশ কিছু এলাকার সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।

 

চিকিৎসকরা যা বলছেন:
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ ও রেসপিরেটরি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান জানান, বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুসজনিত সমস্যার পাশাপাশি মানসিক বা উচ্চ রক্তচাপসহ মানবদেহের বহুমাত্রিক রোগ হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, বায়ুদূষণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বা স্বাস্থ্যঝুঁকি হচ্ছে-সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগ। এর কারণে ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ঢাকা শহরের কিছু স্থানে নমুনা বিশ্লেষণে ২০০ প্রকার জৈব যৌগ শনাক্ত করা গেছে। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বয়স্ক আর শিশুরা। ঢাকার বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর পদার্থ আছে তার মধ্যে অন্যতম অতিরিক্ত সিসা। এটা শিশুর মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের রক্ত পরীক্ষায় ৮০ এমজি বা ডিএল থেকে ১৮০ এমজি বা ডিএল সিসা পাওয়া গেছে, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার সাত থেকে ১৬ গুণ বেশি।

দায়িত্বশীলদের বক্তব্য:
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ডিএনসিসি এলাকার নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িতদের ধুলা নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলাকে বেশি দায়ী করা হলেও এই কারণে মাত্র ১৮ শতাংশ দায়ী।

তিনি বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ঢাকার আশপাশের ইটভাটা। গবেষণা অনুসারে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ৫৮ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া যানবাহনের জন্য ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য ৮ শতাংশ ও অন্যান্য কারণে ৬ শতাংশ বায়ু দূষিত হচ্ছে। এছাড়া ঢাকার বায়ুতে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি বেড়ে গেছে। সব সংস্থার সমন্বয়ে বায়ুদূষণ কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ঢাকা বায়ুদূষণে দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে। এটা আমাদের জন্য সুখকর নয়। ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ দায়ী যানবাহনের কালো ধোঁয়া। জনঘনত্ব বিবেচনায় ঢাকা শহরে এসব বিপজ্জনক ধাতু ও যৌগ পদার্থের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। পাশাপাশি নির্মাণকাজ, রাস্তাঘাট সংস্কার ও খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বায়ুদূষণ ঘটানোয় ১০ শতাংশ দায়ী।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মিঠুন চন্দ্র শীল জানান, সেবা সংস্থাগুলো তাদের সেবা সংযোজনের প্রয়োজনে সড়ক খননের আবেদন করে থাকে। সিটি করপোরেশন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনুমোদন দিয়ে থাকে। ডিপিডিসিও সেভাবে অনুমোদন পেয়েছে। উন্নয়ন কাজের সময় ধুলা নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে তাদের কার্যক্রম তদারকিও করা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে তাদের কাজ শেষ হলে ওই সড়ক ডিএসসিসি সংস্কার করে দেবে।