এ বছর ঢাকা ষষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন (আইওসি) আয়োজন করছে। গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনটি ঢাকার বিভিন্ন ভেন্যুতে ১২ ও ১৩ মে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২৫টি দেশ এবং বিভিন্ন সংস্থার রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী এবং প্রতিনিধিরা এ বছর দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে অংশ নেবেন।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উত্তপ্ত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে, এই সম্মেলন ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলির অভিন্ন বিষয়গুলিতে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই প্রেক্ষাপটে, স্বাভাবিকভাবেই সম্মেলনের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং একই সাথে বেশ কিছু প্রত্যাশাও থেকে যাচ্ছে।
একনজরে ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন
সম্মেলনটি প্রথম ২০১৬ সালে শুরু হয়েছিল। উদ্বোধনী সম্মেলনে, ৩০ টি দেশ যোগ দিয়েছিল এবং পারস্পরিক সাধারণ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সম্মেলনটি শুরু হয়েছিল ভারতের উদ্যোগে। ভারত তার সেফটি এন্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন বা ‘সাগার’ নীতির অধীনে এটি চালু করে। বিগত সাত বছরে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন শহরে পাঁচটি সম্মেলন হয়েছে। ধীরে ধীরে সম্মেলনটি ভারত মহাসাগরের দেশগুলি এবং তাদের অংশীদারদের (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) জন্য একটি বিশেষ আলোচনাধর্মী ফোরাম হিসাবে আবির্ভূত হয়। সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিরা সাধারণত নিরাপত্তা সমস্যা এবং এই অঞ্চলের সমৃদ্ধির সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আলোচনা করেন।
ভারত মহাসাগর সম্মেলনের (আইওসি) ঢাকা অধ্যায়
এবারের আইওসি-র ষষ্ঠ পর্ব ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার আয়োজক এবার বাংলাদেশ। এই বছর সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় “স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং অংশীদারিত্ব”। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১২ এবং ১৩ মে ঢাকায় ২৫টি দেশের একশত পঞ্চাশজন শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করবেন। উল্লেখ্য যে, এবারের সম্মেলনে মিয়ানমারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সম্ভবত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বৈধতা সংকটের কারণে দেশটিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ছাড়াও, ডি-৮, সার্ক এবং বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলির প্রতিনিধিরাও সম্মেলনে অংশ নেবেন। এই বছরের গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের মধ্যে রয়েছে মরিশাসের রাষ্ট্রপতি রোপুন, মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর, মার্কিন উপ-রাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান সহ আরও অনেকে।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যমকর্মী এবং গবেষকও সম্মেলনে যোগ দেবেন এবং বক্তৃতা প্রদান করবেন। অনুষ্ঠানমালা অনুযায়ী এবছর বেশ কয়েকটি বিষয়ভিত্তিক অধিবেশনে ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই ভবিষ্যতের জন্য রোডম্যাপ’, ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা,’ এবং ‘স্থিতিশীল বৈশ্বিক ভবিষ্যতের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ভারত -মহাসাগররের ভূমিকা,’ ‘একটি শান্তিপূর্ণ ও টেকসই ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে নন-ট্রাডিশনাল নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা’-এর মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলবে। বিষয়ভিত্তিক অধিবেশন ছাড়াও, বেশ কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন থাকবে যেখানে অংশগ্রহণকারীরা বৃহৎ আঞ্চলিক বিষয়ের পাশাপাশি নিজদেশের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করবে।
গুরুত্ব এবং প্রত্যাশা
গত কয়েক বছর ধরে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল বৈশ্বিক পরাশক্তিদের দ্বন্দ্বের একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই জটিল ভূরাজনীতির মধ্যে, এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম আঞ্চলিক দেশগুলিকে পারস্পরিক সাধারণ সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দেবে। আঞ্চলিক শক্তি থেকে শুরু করে উপকূলীয় দেশ, বড়, মধ্যম এবং ছোট শক্তির দেশগুলোর অংশগ্রহণ একটি ব্যপক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে আনবে যা একে অপরের অগ্রাধিকারগুলি বোঝার জন্য সাহায্য করবে।
পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন চলাকালীন, দেশগুলি সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সুনীল অর্থনীতির প্রসার, জলদস্যুতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং অবৈধ মৎস আহরণের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে দেশগুলির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়াও, মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পরে বিশ্ব একটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট গোটা ভারত মহাসাগর অঞ্চলকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। এবারের সম্মেলনে সংকটের ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলি নিয়েও আলোচনা হবে বলে আশা করা যায়। পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন এবং অধিবেশনের মূলবক্তৃতাগুলিও সংকট মোকাবেলার উপায় নিয়ে আলোকপাত করবে বলে আশা রয়েছে।
আনুষ্ঠানিক অধিবেশনের শিরোনামগুলি আমাদের মনে প্রত্যাশা জাগায় যে সম্মেলনে অর্থনৈতিক সংকট, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং শরণার্থী সংকট, সন্ত্রাসবাদ, জলদস্যুতা, জলবায়ু পরিবর্তন, স্থানীয় মুদ্রা বাণিজ্য, এবং জ্বালানি সংকটের মতো বেশ কিছু নন-ট্রাডিশনাল নিরাপত্তা বিষয়ে বহুপাক্ষিক আলোচনা হবে। এবং আঞ্চলিক অংশীদারিত্বকে আরো জোরদার করবে।
যেহেতু ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলি জটিল ভূ-রাজনীতির মধ্যে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে, এধরণের বহুমাত্রিক এবং বহুপাক্ষিক সংলাপের সুযোগ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। প্রায়শই, বেশিরভাগ ক্ষুদ্র শক্তিগুলির জাতীয় স্বার্থ পরাশক্তিগুলির স্বার্থের কাছে উপেক্ষিত হচ্ছে অথবা অধরা থেকে যাচ্ছে। উল্লেখ্যযে, বেশিরভাগ ভারতমহাসাগরীয় দেশই প্রায় সকল পরাশক্তির সাথে ব্যবসা, বাণিজ্য কিংবা নিরাপত্তার কারণে সম্পৃক্ত পড়া ও নির্ভরতার জায়গা সৃষ্টি হওয়ায় এই ভূ-রাজনীতিতে সামরিকভাবে জড়িত হওয়া বা কোনো পক্ষাবলম্বনে আগ্রহ নয়।
বরং, তারা নিরপেক্ষতাকে বেছে নিতে চায় এবং পরাশক্তির দ্বন্দ্বে দূরত্ব বজায় রাখতে চায়। যেহেতু দেশগুলির হাতে বিকল্প কমে যাচ্ছে এবং ক্রমেই মেরুকরণ বাড়ছে, তাই এই জাতীয় ফোরাম এই দেশগুলির জন্য বিশেষ গুরুত্ব বয়ে আনে। আছাড়া, পরাশক্তির দ্বন্দ্বের বাহিরেও, ফোরামটি আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে যা ভারত মহাসাগরের বেশিরভাগ দেশগুলি একটি উন্নত ভবিষ্যত ও সমৃদ্ধির জন্য এবং তাদের জাতীয় স্বার্থ পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, প্রত্যাশা বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক, এবং প্রতিনিধিদের কাছ থেকে এটি আশা রইবে তারা যেন উদ্বুত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে এবং সেগুলি মোকাবেলায় তরিকাও খোঁজার চেষ্টা করে।
লেখক: শফিকুল এলাহী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net