ডিবি বনাম সিআইডি আন্ত ডিপার্টমেন্ট খেলা

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ২ years ago

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ থ্রিলার সিনেমা! তামিল কামিল, তেলেগু বেলেগু, বলিউড ঢালিউড, হলিউড জলিউড সব ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রি মিলেও এ থ্রিলার বানাতে পারবে না। ‘১ কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না…?’ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে এমন একটি টেলিফোনের কথোপকথন। ঘুষ লেনদেনের এ ঘটনা ঘটেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তার মধ্যে। ওই টেলিফোন আলাপচারিতায় ছিলেন বর্তমানে সিআইডির চাকরিচ্যুত উপপরিদর্শক (এসআই) আকসাদুদ জামানের স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিন এবং ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভী কোরায়েশি। প্রায় এক বছর তদন্ত করে সম্প্রতি এ ঘটনার সত্যতা পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানকে মালিবাগ থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন এবং জোরপূর্বক মুক্তিপণ বাবদ ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফৌজিয়া খানের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি গত ২৬ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ে উক্ত ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

ঘটনাটি কোন সিনেমা বা নাটকের ড্রামা বা গল্প নয়। সিআইডির এসআই আকসাদুদকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা মাত্র! মুক্তিপণ আদায়ের হিস্টরি। খোদ সিআইডি বনাম ডিবির মধ্যে ঘটে যাওয়া মুক্তিপন আদায় ও চাঁদাবাজির কাহিনী। ভুতের মধ্যে সরিষা! বিষয়টা যেনো এরকম, মামাতো বোনকে কিডনাপ করে ওয়ারিশ আদায় করলো ফুপাতো ভাই!

১ কোটি ৪২ লাখ টাকাও একজন সরকারি কর্মকর্তা (এসআই) মুক্তিপন দেওয়ার সামর্থ রাখেন? আর সে মুক্তিপন আদায় করে আরেক সরকারি কর্মকর্তা (ডিবি)। ঘটনাটি গত ২৩ মার্চ ঢাকার একটি প্রথমসারীর জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে প্রকাশ হয়। একজন এসআই তার ইনকাম দিয়ে কীভাবে ১.৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিল, জানতে চায় আমাদের অবুঝ মন! বিষয়টা যেন ডিবি ভারসেস সিআইডি ‘আন্তডিপার্টমেন্ট খেলা’! কাঁপাও বাংলাদেশ! যাকে বলে, সেয়ানে সেয়ানে খেলা! এটা ঘরোয়া লীগের খেলা, আসল খেলা (খুন, গুম, অপহরণ) হবে সাধারণ জনগণকে নিয়ে। ঘরের মাঠেও প্রাক্টিস করতে হয়। আগামীতে ডিবির কাউকে সিআইডির তরফ থেকে তুলে নিয়ে ৩.৫ কোটি আদায় করলেই হিসাব ওভার কাম হয়ে যাবে।

২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েন দুবাইপ্রবাসী রোমান মিয়া। ফুফাতো ভাই মনির হোসেনকে নিয়ে তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যাচ্ছিলেন। কাওলা পদচারী সেতুর কাছে মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল দিয়ে তাদের পথ আটকানো হয়। মনিরকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে ‘ডিবি’ পরিচয় দিয়ে রোমান মিয়াকে মাইক্রোবাসে তুলে নেন দুর্বৃত্তরা। হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে ৫ হাজার মার্কিন ডলার ও ২ হাজার দিরহাম ছিনিয়ে নিয়ে রামপুরা এলাকায় ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরবর্তী তদন্তে প্রবাসী রোমান মিয়াকে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া ও ডাকাতির ঘটনায় সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানসহ নয়জন জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুদকে তুলে নেওয়া ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সকালে আকসাদুদকে মালিবাগ মোড় থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) বিমানবন্দর জোনাল টিমে কর্মরত কায়সার রিজভীসহ তার দলের সদস্যরা আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে তাকে বলা হয়, কাওলায় প্রবাসী রোমান মিয়ার অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আরও পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তারা এ ঘটনায় আকসাদুদের নাম বলেছেন। একপর্যায়ে অভিযোগ থেকে তাদের রেহাই দেওয়া নিয়ে কথা হয়। কায়সার রিজভী কোরায়েশি ২ কোটি টাকা চান। এ সময় কায়সার রিজভীর ফোন দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আকসাদুদ তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। পরে আটক ব্যক্তিদের সবাইকে মুঠোফোনে তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়। কথামতো সবাই আকসাদুদের বাসায় টাকা রেখে যান। আকসাদুদ দিয়েছিলেন ৩৩ লাখ টাকা, আর বাকি ৫ জন দেন ৯৫ লাখ টাকা। ওই দিন সন্ধ্যার পর আকসাদুদকে সঙ্গে নিয়ে খিলগাঁও ঝিলপাড় এলাকায় তার বাসায় গিয়ে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা নিয়ে আসেন ডিবির কায়সার রিজভীসহ তার টিমের সদস্যরা। তখন আকসাদুদকে আবার ডিবি অফিসে আনা হয়। পরে তার স্ত্রী কায়সার রিজভীকে আরও ১৪ লাখ টাকা দেন।

যাই হোক, আমাদের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের আনলিমিটেড ধন্যবাদ। দেরিতে হলেও তাদের ইনভেস্টিগেশনে ঘটনাটি প্রকাশ পেয়েছে। যে কাহিনীতে সাধারণ মানুষের বিনোদন পাওয়ার বিষয় রয়েছে। টোপিকটি এমন যে, একই পথে কামাইরত, এক চোর গেছে আরেক চোরের বাড়িতে চুরি করতে! যাকে বলা হয় ‘চোরের উপর বাটপারি’। ডিবির হিসাব ঠিক আছে, এতো টাকা এক মুঠে পাবলিকের কাছে পাওয়া সহজ নয়।

এ থেকে স্পষ্ট ঠাউর করা যায়, সিআইডি কত টাকা ইনকাম করছে, আর যাতে ডিবির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চারিদিকে শুধু কোটির গন্ধ। দাতা-গ্রহীতা দুইজনের কাছেই কোটির হিসাব। কিন্তু আমাদের মনে খটকা থেকে যায়, পরবর্তীতে কোটির জায়গায় কৌটা হবে না তো? পরস্পরের মধ্যে এরকম প্রতিযোগিতা হওয়ায় আমরা জানার অপেক্ষায় থাকলাম, কে বেশি পাঁকা খেলোয়াড়, সিআইডি না ডিবি। নিজেদের মধ্যেই যদি এতো অন্যায়, অনৈতিকতা, নোংরামি থাকে, তাহলে এরা জনগণের নিরাপত্তা তো দুরে থাক, তাদের সাথে কি পরিমাণ মিস জাজমেন্ট করে তা ভাবা যায়? ডিবি যদি একজন সিআইডি পুলিশকে অপহরণ করতে পারে, তাহলে বোঝা যায়, এরা অনেক সাধারণ পাবলিককেও এভাবে অপহরণ করে মুক্তিপন আদায় করছে।

সিআইডি বনাম ডিবির ঘটনায় আমাদের দেশের কতিপয় (সবাই নয়) সরকারি কর্মকর্তার প্রকৃত চরিত্রটা প্রকাশ পেল। হাত মারতে মারতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, এখন কোথায় হাত দেয় সে কনসিডারেশন সেন্সও হারিয়েছেন। আমরা তো জানতাম শিয়াল মুরগী শিকার করে, এখন দেখা যায়, শিয়াল শিয়াল শিকার করেছে। জোকের গায়েও জোক লাগছে।

সরকার পুলিশকে আর কি দিলে তাদের কলসি ভরবে? বেতন বাড়লে সরকারি চাকুরীজীবিরা ঘুষ খাবেন না, তাই সরকার বেতন বাড়িয়েছে। আজকে আমরা সত্যি লজ্জিত। যেখানে দেশের শান্তি ও মানুষের সেবার জন্য পুলিশ বাহিনীকে সরকার দেশের আনাচে কানাচে পাঠায়। সে পুলিশকে দেখলেই মানুষ ভয়ে আতংকিত হয়ে পরে। আপনাদের যদি চাকরির টাকায় সংসার না চলে, তাহলে অন্য পথ বেছে নিন? দুধ কলা দিয়ে যেমন কালসাপ পোষা হয়, ঠিক তেমনি এরা হল কালসাপ। এরা সুযোগ বুঝে নিরীহ মানুষকে ছোবল মারে। কি ভয়ংকর! না জানি এরা এতদিনে আরও কত অপকর্ম করেছে। ওদের চাহিদা মেটাতে না পারলে কত মানুষকে জেল, জুলুম, নির্যাতন, গুম, গভীর রাতে বন্দুকযুদ্ধে যেতে হয়েছে। পরেরদিন পত্রিকায় আরেকটি গতানুগতিক বন্দুকযুদ্ধের কাহিনী! আমরা ভীষণভাবে অবাক হই, লজ্জিত হই এগুলো দেখলে। এদের কারণে পুলিশ ফোর্সের অর্জন তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে, আর দায় গিয়ে পড়ছে সরকারের ঘাড়ে। পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত এমন অফিসার, ভাই-বন্ধুদের চিনি এবং দেখি, যারা অপরাধীদের পেছনে ২৪ ঘণ্টা লেগে থাকেন। রাতে ঠিকমত বাসায়ও আসতে পারেননা, পরিবারকে ঠিকমত সময় দিতে পারেননা। সে সকল অফিসারদের মুখে যারা চুনকালি দিয়ে থাকে দুর্নীতিবাজরা। এসব অতিউৎসাহী পুলিশ সদস্যদের জন্য আজ সরকারও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম)প্রাপ্ত সুভাষ চন্দ্র ও তার স্ত্রীর নামে ১৯টি এফডিআরে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা থাকার খবর আমরা দেখেছি। এগুলোকে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে? জনগণ যাবে কোথায়? কোটি কোটি টাকার এ দুর্নীতি তো একদিনে হয়নি, আবার পিপিএম পদক পাওয়ার পরেরও নয়। তাহালে প্রশ্ন থেকেই যায়, এ পুলিশ সুপারের পিপিএম পদক পাওয়ার ভিত্তি বা বিবেচনা কি দুর্নীতিগ্রস্থতায় পুষ্ট? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদধারী ও সম্মানিত ব্যক্তির নামে পদক প্রদানের জন্য যারা এ দুর্নীতি সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির নাম সুপারিশ করলেন ও মনোনিত করে রাষ্ট্র তথা সমগ্র জাতিকে কলুসিত করলেন তারা কারা? কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির আচার-আচরণে কি কিছুই অনুমান করা যায় না? না কি সবাই একই রকম? এদের দ্বারা কি নিরপেক্ষতা আশা করা যায়? সবাই অসৎ আমরা তা মনে করি না। কিছু সৎ পুলিশ অফিসার তো আছেনই, তবে তারা হয়ত কোনঠাসা।

 

লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান
ইমেইল: abunoman1972@gmail.com


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net