ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশে আলাদা আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। বৈষম্যমূলক আইন, নীতি এবং অনুশীলনের কারণে ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষসহ যৌন বৈচিত্রমুখী ব্যক্তিরা এখনও তাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন ।বাংলাদেশ প্রায়শঃই তাদের পরিচয় গোপন করে জীবন যাপন করতে হয়।
রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) ঢাকায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন কর্তৃক ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তথ্য অধিকার আইনের (আরটিআই) ব্যবহারের উপর তিন দিন ব্যাপী আয়োজিত প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই কথাগুলো উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ কামাল উদ্দিন আহমেদ এই প্রশিক্ষণের উদ্বোধন করেন। আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের রাজনৈতিক বিষয়ক প্রথম সচিব কর স্টৌটেন, আর্টিকেল নাইনটিন এর আন্তর্জাতিক সিনিয়র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ডেভিড ডিয়াজ-জোগেক্স, রিসার্চ ইনিসিয়েটিভস বাংলাদেশ এর আরটিআই বিষয়ক সহকারী পরিচালক অ্যাডভোকেট রুহি নাজ এবং নো পাসপোর্ট ভয়েস এর ট্রান্সজেন্ডার অধিকার বিষয়ক শুভেচ্ছা দূত হো চি মিন ইসলাম।
অনুষ্ঠানে আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মরিয়ম শেলি ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার সুরক্ষায় আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।
দেশব্যাপী ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ৩০টি কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন এর ৩০ জন প্রতিনিধি যারা নিজেরাও ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন । তথ্যে প্রবেশগম্যতা ও তথ্য ব্যবহার করে কিভাবে নিজের ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবনমানের উন্নয়ন করা যায় তার উপর তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। বাংলাদেশের সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনে দলিত, হিজড়া, ধর্মীয়, জাতিগত, অনাগরিক এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার সংক্রান্ত কমিটি আছে। আমরা ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অ্যাডভোকেসি করব।”
ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের রাজনৈতিক বিষয়ক প্রথম সচিব কর স্টৌটেন বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে এগিয়ে আছে। এটা খুবই প্রশংসনীয়।”
আর্টিকেল নাইনটিন-এর আন্তর্জাতিক সিনিয়র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ডেভিড ডিয়াজ-জোগেক্স বলেন, “সম্প্রতি স্পেন সরকার ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষের স্বীকৃতি ও অধিকার রক্ষায় আইন প্রণয়ন করেছে। ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষকে তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। সমাজে পরিবর্তন আনার যেকোন প্রচেষ্টায় বাধা আসে কিন্তু এই সব বাধা দূর করেই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।”
নো পাসপোর্ট ভয়েস-এর ট্রান্সজেন্ডার অধিকার বিষয়ক শুভেচ্ছা দূত হো চি মিন ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ থেকে এগিয়ে আছে। এসব দেশে ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য আইন আছে ও তাদের অধিকার সুরক্ষায় বোর্ড থাকলেও বাংলাদেশে নেই। ফেলোশিপ, লিডারশীপ প্রশিক্ষণ ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কাজ করা মানুষের নেতৃত্বের উন্নয়ন ঘটাতে হবে”।
সুস্থ জীবন-এর সভাপতি পার্বতী আহমেদ বলেন, “সুস্থ জীবন ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের মানবাধিকার, স্বাস্থ্য ও আইনি সহযোগিতা নিয়ে কাজ করে।”
সিড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী বলেন, “ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আগত জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণের আমাদের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন না। আমাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোও তাদের প্রতিষ্ঠানে আমাদেরকে কাজ দিতে চায় না। প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতার অভাবে আমাদের কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশনগুলো কাজ করতে পারছে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন করতে চাইলে বলে এগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত। সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে আমাদেরকে মনোনয়ন দিতে হবে যাতে আমরা জাতীয় সংসদে আমাদের কথা তুলে ধরতে পারি।”
দিনের আলো হিজড়া সংঘের কোষাধ্যক্ষ মো. সোহেল আহমেদ (জুলি) বলেন, “দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের অনেক উদ্যোক্তা রয়েছে। ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে আমরা দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারব।”
বাঁচার আশা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা সরকার বিজলী বলেন, “ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পেছনে অনেক ত্যাগতিতিক্ষা আছে। আমাদের অধিকার রক্ষায় আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”
সভাপতির বক্তব্যে আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, “বাংলাদেশে বৈষম্যমূলক আইন, নীতি এবং অনুশীলনের কারণে যৌন বৈচিত্রমুখী ব্যক্তিরা এখনও তাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন ।বাংলাদেশে প্রায়শঃই তাদের পরিচয় গোপন করে জীবন যাপন করতে হয়। যৌন অভিমুখিতা বা লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে দেশের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।”
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net