রোমান্টিক শুনলেই মনটা উতলা হয়। ফিরে যাই তারুণ্যে। রোমান্টিকতা তখনি মধুর হয় যখন টক ঝাল মিষ্টি থাকে। তা না হলে পানসে পানসে লাগে। আমার সংসার জীবন বড় রোমান্টিক। টক ঝাল মিষ্টি তো আছেই, সাথে আছে নোনতা। নোনতা না থাকলে জীবনটা ফ্যাকাশে হয়ে যেত।
চাকরি জীবনে প্রায় দেড় বছর লক্ষ্মীপুর ছিলাম। সরকারি একটি প্রজেক্টের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। মজার ব্যাপার লক্ষ্মীপুরের মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আপনার বাড়ি কোথায়, উত্তরে বলবে নোয়াখালী। ছোটবেলা থেকেই আমার কয়েকটি জেলার মানুষ সম্পর্কে নেগেটিক ধারনা ছিল। তারমধ্যে নোয়াখালীও ছিল। যেহেতু নেগেটিভ ধারনা সেহেতু আগে থেকেই একটু ভয় কাজ করত।
ঢাকা বিভাগের বাইরে প্রথম নতুন জেলায় যাওয়া। তারিখটি মনে নাই, তবে মাসটি ছিল জুলাই, সাল ২০০৩। সাভার থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরের উদ্দেশ্যে রওনা। সঙ্গে ছিলেন অফিসের পরিচালক কৃষিবিদ মো: রফিকুল ইসলাম মোল্লা। রায়পুরে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। আগে থেকেই সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন হাবীব ভাই, হিমু ভাই এবং নতুন অফিসের সহকর্মী হারুন-অর-রশীদ। পরিচালক মহোদয় আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন কমলনগর অফিসে।
রায়পুর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন নতুন বাজারে এক ভাড়া বাড়িতে অফিস ছিল। সহকর্মী হারুন রাতের মধ্যেই সব কাজ বুঝিয়ে দিলেন। পরের দিন সকালে মুষলধারে বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি শেষে হারুনকে সাথে নিয়ে উপজেলা পরিষদ ও আশপাশের এলাকা ঘুর দেখলাম। মানুষের বাড়ি-ঘর, বিপণীবিতান, রাস্তাঘাট বেশ উন্নত। হারুনের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরের চরফলকন। উনি খুব ভালো মনের, সব সময় আমার খেয়াল রাখতেন। প্রজেক্টের সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে খুবই সুনামের সাথে করা সম্ভব হয়েছে একমাত্র হারুনের সহযোগিতায়।
আমি যে প্রজেক্টে ছিলাম একই প্রজেক্ট রায়পুরের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান জনসেবা কেন্দ্র বাস্তবায়ন করত। একদিন পরিচিত হতে হারুনকে সাথে নিয়ে ওই অফিসে যাই। জনসেবার নির্বাহী পরিচালক নাসরিন সুলতানার সাথে পরিচিত হওয়ার পর তিনি পরিচালক সামছুউদ্দীন দেওয়ান, কো-অর্ডিনেটর মুরাদ ও মাস্টার ট্রেইনার নুসরাত জাহানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। মেয়েটাকে দেখে ভালো লাগলো, কেমন সুন্দর চোখ মুখ! মুখটা ভারী মিষ্টি, পরণে হালকা নীল রঙের শাড়ি।
প্রজেক্টে লোকবল নিয়োগ, কেন্দ্র স্থাপন, প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন ইত্যাদি কাজে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় জনসাধারণ আমাকে সহযোগিতা করেন। এসব কাজ করতে গিয়ে তাদের সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। এলাকার লোকজনের আচরণ, ব্যবহার, আতিথিয়তায় আমার ছোটবেলার ভ্রান্ত ধারনা বদলে যায়।
জনসেবা কেন্দ্র ও আমার প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ছিল এক ও অভিন্ন। তাই কাজের সুবাধে উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একে অপরের অফিসে যাতায়াত ছিল। এই যাতায়াতে মাঝে কদাচিৎ নুসরাত জাহানের সাথে দেখা হতো, তবে কথা হতো না। হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা, কেমন আছেন, কোথায় যাচ্ছেন-এমন দুই একটি কথা মাত্র, সেটাই প্রথম। এরপর মাঝে মাঝে অফিসে দেখা ও কথা হতো। আমার ভালো লেগে যায়। উভয় পরিবারের অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজনের আলাপচারিতায় ২০০৪ সালে ৮ জুলাই আমরা বিয়ে করি।
আমার স্ত্রীর ডাক নাম তামান্না। আমি তামান্না বলেই ডাকি। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তামান্না সবার ছোট। ভীষণ আদরের বোন। প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে। এলাকায় এক নামেই তামান্নাদের পরিবারকে সবাই চিনে ও জানে। বাবা এলাকায় জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন।
সাধারণ মানুষের সাংসারিক জীবনের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম আমার সাংসারিক জীবন। ব্যতিক্রম এ কারণেই, আমাদের সংসারে টক ঝাল মিষ্টি সাথে রয়েছে নোনতার সমাহার। ছোট ছোট বিষয়ে ঝগড়া, মান অভিমান, হাসি-ঠাট্টা প্রায় প্রতিদিনই দুজনের মধ্যে লেগেই থাকে। বিয়ের তারিখ, স্ত্রীর জন্মদিন প্রায় সময় আমার মনে থাকে না। তবে দুই সন্তানের জন্মদিন কখনো ভুলি না। এ নিয়ে তাঁর অভিমানের শেষ নেই। কথাও শোনাবে সেইসাথে ঝগড়া। বেশিক্ষণ মান অভিমান করে থাকতে পারে না। ছেলেদের শুনিয়ে বলতে থাকে, তোর বাবা সবকিছুই মনে রাখতে পারে, শুধু এই দিনগুলোই মনে রাখতে পারে না।
আমার বাজার করার তেমন অভ্যাস নেই। এছাড়া আমি ঠিকমতো বাজার করতেও পারি না। বিয়ের কয়েকদিন পর বাজার থেকে দশ কেজি ওজনের বড় একটি বোয়ালমাছ কিনলাম। বউয়ের কষ্ট হবে ভেবে মাছটি কেটে আনলাম। ভাবলাম খুশি হবে, ঘটলো তার উল্টো। মাছ কাটার টুকরোর সাইজ দেখে সে কি রাগ। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, বড় মাছ কাটতে তোমার কষ্ট হবে ভেবেই..। কথা মাটিতে পড়তে না পড়তেই বলতে লাগলো, আমি চেয়ারম্যানের মেয়ে এর চেয়ে বড় বড় মাছ কেটেছি, বাড়িতে প্রতিদিন শতশত মানুষ আসতো বোনেরা মিলে রান্না করেছি। মাছ কাটার আগে তো আমাকে ফোন দিতে পারতে। শান্ত করতে আমি বললাম ভুল হয়েছে, এরপর না কেটেই নিয়ে আসবো। একদিন পরীক্ষা করতে বাজার থেকে প্রায় সাত কেজি ওজনের কাতলমাছ কিনে আনলাম। দেখি কেমন করে কাটে। মা তো বেশ রাগ। এত বড় মাছ বউ কি করে কাটবে। বাজার থেকে কেটে আনতে পারলি না। আমি মনে মনে হাসলাম। এবার মজা দেখবো। অবাক করা ব্যাপার নিমিষেই তামান্না মাছটি সুন্দরভাবে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললো।
মাহে রমজান মাস। পবিত্র শবে কদরের রাত। ৩১ অক্টোবার, সোমবার। মিনার থেকে ভেসে আসে ফজরের আজানের সুর। এসময় মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ঠ হয় প্রথম পুত্র সন্তান, ত্বকী তাহমিদ। বংশের প্রথম প্রদীপ। সূর্যের আলোর মতো দ্রুত গতিতে আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে পড়লো চারদিক। আনন্দের খবরে দাদি, নানী, ফুফু, খালা, মামা, চাচা সবার মুখে হাসি ফুটলো। বড় ছেলের জন্মের তিন বছর পর ২১ মার্চ শনিবার রাতে জন্ম নিল ছোট ছেলে মিফতাহুল জান্নাত তেহামী। ছোট ছেলে ভূমিষ্ঠের পর চিৎকারের সাথে সাথে নার্সের মোবাইল রিংটোনে আজানের সুর বেজে উঠে।
বড় ছেলেটি একটু শান্ত, তবে ছোটটি বেশ দুষ্টু। বাসায় প্রতিদিন দুই ভাইয়ে ছুটাছুটি, লাফালাফি, দৌড়াদৌড়ি, মারামারি করে। এ নিয়ে তামান্না ওদের সাথে চিৎকার চেচামেচি, এমনকি মাঝে মধ্যে মাইর পর্যন্ত দেয়। এছাড়া পড়া নিয়ে তো সর্বক্ষণ বকতেই থাকে। ছেলেদের মারা ও পড়া নিয়ে বকাতে কিছু বললেই রেগে গিয়ে অমনি গ্রামবাংলার বিবাহিত নারীদের কমন সংলাপ-‘শুধু আমি দেখে তোমার সংসার করছি! আমি ছাড়া অন্য কেউ হলে তোমার বারোটা বাজত’। এমন উত্তরে যখন বলি, তুমি আছো বলেই আমাদের বারোটা বাজে, নয়তো তেরোটা বেজে যেত। সোনার এই সংসারের কি যে হাল হতো, সারাজীবন তুমি এভাবেই আমাদের সাথে থেকো। মুহূর্তেই সব রাগ যেন পানি হয়ে যায়, মুচকি হেসে বলে এখন থেকে সংসার তুমি সামলাবে, আমি পারব না। ঝগড়া খুবই মজার জিনিস। যদি তা যুক্তি তর্কের ধার ধেরে হয়। কিন্তু গাধা মানুষেরা ঝগড়ার সময় যুক্তি তর্কে ভুলে গালাগালি করে তবে সেটা হয় অশান্তির।
বড় ছেলের স্কুলের প্রথম দিন, প্রথম ক্লাস। সকালে ঘুম থেকে ছেলেকে ডেকে উঠানো হলো। আমিও অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। তামান্না ছেলেকে রেডি করে দিয়ে বললো, যাও ত্বকীকে স্কুলে দিয়ে এসো। বললাম অফিসে কাজ আছে তাড়াতাড়ি যেতে হবে, তুমি নিয়ে যাও না। ছেলে বায়না ধরেছে তোমার সাথে যাবে, ঠিক আছে তুমিও সাথে চল। আমার বাসায় কাজ আছে, তেহামীকেও খাওয়াতে হবে, আমি পারব না। স্কুল ছুটি হলে আমি গিয়ে নিয়ে আসব। কি আর করার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে গেলাম। ক্লাসে বেঞ্চে ঠিকমতো বসিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পাশে বসে রইলাম। ক্লাসরুমে টিচার ঢুকতেই আমি বের হওয়ার জন্য দাঁড়াতেই ছেলে তার নরম হাত দিয়ে আমার হাত ধরলো। আমাকে ছাড়া কিছুতেই ক্লাসে বসবে না। অগত্যা ছেলের সাথে বসে ক্লাস করলাম। বাবা-ছেলের একসাথে বসে প্রথম ক্লাস। বহুবছর পর স্কুল জীবনের মিষ্টি অনুভূতি অনুভব করলাম।
ছোট ছেলে তেহামী তার বাবার প্রতি একটু বেশি ভালোবাসা। ২১ মার্চ তার জন্মদিন। ২০২৩ সালে জন্মদিনে জমানো টাকা দিয়ে একটি ঘড়ি কিনে। ঘড়িটি হাতে পরিয়ে দিয়ে বলে আমার জন্মদিনে তোমার জন্য উপহার। আমি ভীষণ অবাক! বললাম ঘড়ি তো আছে বাবা। উত্তরে বললো, সেটা নষ্ট আমি জানি। কাল থেকে তুমি এই নতুন ঘড়ি পরে অফিসে যাবে। ছোট ছেলে নিজে হাতে পরিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেক বছর পর বাবার হাতের ছোঁয়া অনুভুব করলাম।
উনত্রিশ ডিসেম্বর ২০২১ সাল। লক্ষ্মীপুর থেকে আমরা সবাই বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরেই তামান্না কয়েকবার বাথরুমে যায়। সবাই ক্লান্ত তাই একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। এরমধ্যে তামান্না বেশ কয়েকবার বাথরুমে গেছে। হঠাৎ রাত ২টায় তামান্না ডেকে বলে শরীর খুব খারাপ লাগছে, বাথরুমে যাব সেই শক্তিও পাচ্ছি না। ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলাম। বাথরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় এস পড়ে গেল, বললো আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও, শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। এত রাতে কীভাবে কি করব, বোঝতে পারছিলাম না। প্রতিবেশীদের ডাকা হলো। অটো রিকশা করে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এরমধ্যে ডিহাইড্রেশন শুরু হয়ে গেছে। শরীর বরফের চেয়েও ঠান্ডা হয়ে গেছে। জরুরি বিভাগের ডিউটি ডাক্তার দেখে বললেন রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। স্যালাইন লাগাতে হবে। কেনলা লাগাতে কিছুুতেই নার্স ভেন পাচ্ছিলেন না। হতাশ হয়ে ডাক্তার বললেন দ্রুত ঢাকা নিয়ে যেতে। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। উপায়ন্তর না পেয়ে চাচাতো বোন শ্যামলী (বিসিএস ডাক্তার) কে ফোন করলাম। শ্যামলী ফোনে ডিউটি ডাক্তারের সাথে কথা বলে ভর্তি নিতে বলেন। বেডে নিয়ে যাওয়ার পর সাথে সাথেই দুই তিনজন ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় চলে আসেন। ওয়ার্ড বয় কিছুক্ষণ চেষ্টা করে কেনালা লাগাতে সক্ষম হয়।
দুই হাতে দুইটা স্যালাইন চলতে থাকে। ডাক্তারা কিছুক্ষণ পরপর প্রেসার, ডায়বেটিকস চেক করতে থাকেন। প্রেসার কিছুটা স্বাভাবিকে না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তার, নার্স কেউ এক মিনিটের জন্যও তামান্নার কাছ থেকে সরে নাই। ইন্টার্নি ডাক্তার উবায়েদ ও ডাক্তার ডায়না এই দুইজনের অক্লান্ত চেষ্টায় কয়েক ঘন্টা পর আল্লাহর রহমতে প্রেসার স্বাভাবিক হয়। উনারা দুইজনই ছিলেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের। তামান্না দুই রাত হাসপাতালে ছিল। সারারাত জেগে পাশে ছিলাম। নানা ভাবনায় মনটা বিষণœ ছিল। তামান্নার সুস্থতার জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম। মনে মনে বললাম আর কখনো ওর সাথে ঝগড়া করব না। সবার দোয়ায় আল্লাহ্র কৃপায় সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসলো।
বেশ কিছু দিন দু’জনের মধ্যে কোনো ঝগড়া, মান অভিমান বন্ধ ছিল। এই অবস্থা বেশি দিন থাকলো না। সংসার জীবন পানসে ও ফ্যাকাশে মনে হতে লাগলো। সেইসাথে কিসের যেন শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম। আবার শুরু হলো ছোট ছোট বিষয়ে ঝগড়া, মান অভিমান, হাসি-ঠাট্টা। ফিরে এলো টক ঝাল মিষ্টি, সাথে নোনতা।
লেখক: মো. নবী আলম, সাংবাদিক।