সিটি কর্পোরেশনে ‘মশা’ হলো লুটপাটের একটি হাতিয়ার! যত মশা, তত বড় বাজেট, তত বেশি লুটপাট। এর আগেও সিটি কর্পোরেশন কীটনাশক সরবরাহ করেছে যাতে কোন কাজ হয়নি। এদের ব্যবসার ধরনটা হচ্ছে ‘গিভ এন্ড টেইক’। কার্যকারিতা টেস্টের রেজাল্ট এদের পক্ষে আসবে কিন্তু মশা মরবে না। এমনি ব্যবসার উৎস কে বন্ধ করতে চায়? এবারের জালিয়াতির অভিনব ‘ফেন্সি’ গল্পটা জেনে সর্বসাধারণ যে শুধু খুব কষ্টই পাবেন তাই নয়; বরং এতে মহা হাসিরও খোরাক রয়েছে। বাংলাদেশের সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড চাইনিজ একজনকে ভাড়া করে (বাংলাদেশেই যে অন্য চাইনিজ কোম্পানিতে কাজ করে) তাকে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালের এক্সপার্ট হিসাবে নাটক মঞ্চায়ন করেছে। এদেশে পকেটে কিছু ঢুকলে ‘জিঞ্জিরার’ মালটাও ‘সিংগাপুর’ বনে যায়, এটা ঐকিক নিয়ম। ভেবেছিল, সিঙ্গাপুর আর চাইনিজ চেহারা দুয়ে দুয়ে ছয়… সিমিলারিটি বনে কেল্লাফতে!
আসলে হয়তো মিলে মিশে খেতে চেয়েছিল, কিন্তু বেরসিক গণমাধ্যম রিপোর্টটি পাবলিসিটি করে দিলো। কী দরকার ছিল গণমাধ্যমের ঢাকা উত্তর সিটির গায়েপড়ে লেগে যাওয়া? অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের আনইন্টারেস্টিং বেস্ট কেমিক্যাল বিবৃতিটা না দিলে এই ঘটনাটা আর দশটা প্রতারণার মতো গোপনই থেকে যেত বলে আমরা ধারনা করছি। করোনার সময় চিকিৎসার নানা ক্ষেত্রে দেশব্যাপী একটি অসাধু চক্র সুচতুরভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অর্থের পাহাড় গড়েছিলো। তেমনি ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও ওই একই ক্যাটাগরির চক্র সক্রিয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জন্য মশা মারতে আনা বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) আসল নয়। মশার লার্ভা নিধনে নতুন কীটনাশক-বিটিআই আমদানি নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি করেছে সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্যাকেটের গায়ে উৎপাদনকারী হিসাবে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা থাকলেও তা আনা হয় চীনা কোম্পানি শানডং গানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল থেকে। এতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানেরও কোনো হদিস নেই, নেই কোনো ব্র্যান্ড এবং পিএইচপি নম্বর, ব্যবহারবিধি কিংবা প্রয়োগের মাত্রাও উল্লেখ নেই। এমনকি মেয়াদ ফুরানোর কোনো তারিখও নেই। অথচ প্যাকেটের গায়ে কিউলেক্স মশার ছবি দিয়ে ডিএনসিসি থেকে প্রচারণা চালানো হয়। যা ছিল এডিস নিধনের প্রচারণা। এসব কীটনাশক ছিটানোর পর এডিশ মশার লার্ভা ধ্বংস হচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় দুই দফায় কার্যক্রম উদ্বোধন করলেও বিটিআই’র কার্যকারিতার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এদিকে কীটনাশক বিটিআই জালিয়াতির অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা খতিয়ে দেখছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে।
অদূরদর্শিতা, নীতিহীনতা, সুষ্ঠ পরিকল্পনার অভাব, টাকা পয়সার অপচয়, মারিং-কাটিং ইত্যাদি যা-যা টার্ম আছে, সরকারের যে কোনো পরিকল্পনার মধ্যে তার সবই আমরা দেখতে পাই। ডেঙ্গু তো একটা ইগজাম্পল মাত্র। এ বছরের চট্টগ্রামের অবস্থা কে না জানে? কতো টাকা খরচ করলো জলাবদ্ধতা নিরসনে? ফলাফল শুন্য?
সিটি কর্পোরেশনের শীর্ষ কর্তাদের এ-ই কি কর্মদক্ষতা? ঘুষখোর, চোর, ডাকাত, প্রতারক, ভেজালকারবারী, দুর্নীতিবাজ যেখানে পরতে পরতে; সখ্যতা-সিন্ডিকেট যেখানে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়; তখন এমনটিই স্বাভাবিক। এটা চোরের রাজত্ব না-কী? আমরা মনে করি, সর্বত্র কঠিন শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন, প্রয়োজন সকল অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোসহীন ‘যুদ্ধ’। সরকার, প্রশাসন, কর্পোরেশন যদি এ যুদ্ধ চালাতে আনসাকসেসফুল হন, তাহলে এই মশাগুলোর বিরুদ্ধে ‘হেলমেট বাহিনীকে’ খেপিয়ে তুলুন, তাহলে দেশে একটি ডেঙ্গু মশাও থাকবে না। এতেও যদি কাজের কাজ না হয়, দরকার হলে এগুলোর বিরুদ্ধে ‘গায়েবানা’ মামলা দিয়ে দিন। এতেও যদি কাজ না হয়, খুন-গুমের হুমকি দিন, দেখবেন ডেঙ্গু মশাগুলো নিজেরাই গুম হয়ে গেছে!
যেখানে ডেঙ্গুতে দিন দিন বেড়েই চলেছে মৃত্যুর মিছিল। আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ধুঁকছে, ভুগছে। হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতরা। নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। এ পরিস্থিতিতে লার্ভা নিধনের ব্যাকটেরিয়া বিটিআই আমদানিতে জালিয়াতি করছে নরপশুরা। কী ভয়ঙ্কর তাদের বিবেক! হাসপাতালে মানুষে গিজগিজ করছে, সবাই জ্বরের রোগী! রক্ত পরীক্ষার রুমে রোগীদের বিশাল লাইন, স্ট্রেচারে করেও রোগী আসছে। ভয়াবহ অবস্থা! এত ভিড়ের কারণ ডেঙ্গু। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে কোনো কোম্পানি এমন ভুয়া কাজ করতে পারে, যাদের ন্যূনতম মনুষত্ববোধ আছে। ব্যবসা মানে তো লুটপাট না, যা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সিটি করপোরেশনের পার্সেসিং, ভান্ডার ও ক্রয় বিভাগ যেভাবে মশার ওষুধের নামে পানি আনে, এখানেও তাই হয়েছে। এমন অভিনব প্রতারণা কীভাবে মেনে নেয়া যায়? কিন্তু পরিস্থিতি কেন এতো খারাপ হলো, এর দায় কার? কার কাছে তার জবাব?
ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি মশা নিয়ন্ত্রণের নামে তামাশা! ব্যাঙ, মাছ আর হাঁস দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের নাটক। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা দেখা যায় না। মশার লার্ভা ও প্রজননস্থল ধ্বংস করতে সিটি কর্পোরেশন লেক, খাল, জলাশয়ে মাছ অবমুক্ত থেকে শুরু করে, হাঁস বা ব্যাঙেরও প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু এ সব পদক্ষেপে সুফল পাওয়া যায়নি বলেই অভিযোগ নগরবাসীর। কিউলেক্স মশা নিধনে ডিএসসিসি নগরীর বিভিন্ন ড্রেনে গাপ্পি মাছ অবমুক্ত করেছিল। কিন্তু ঢাকার ড্রেনের পানি এতটাই দূষিত যে কয়েকদিনের মধ্যেই গাপ্পি মাছ মরে ভেসে উঠে। তখন অনেক সমালোচনা হয় বিষয়টি নিয়ে। মাছ দিয়ে মশা নিধন ব্যর্থ হওয়ার পর হাজার হাজার হাঁস রাজধানীর বিভিন্ন খাল, ঝিল ও জলাশয়ে ছেড়েছিল ডিএসসিসি। তদারকির অভাবে পরবর্তীতে হাঁসগুলো গায়েব হয়ে যায়। গাপ্পি মাছ ও হাঁস দিয়ে মশা নিধনের ব্যার্থ প্রচেষ্টার পর রাজধানীর খাল, ঝিল, লেক, পুকুর ও জলাশয়ে নামানো হয় বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙ। এটিও ছিলো ডিএসসিসির জাস্ট এ ফেইলড এটেম্পট।
মশার লার্ভা নিধন সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ হলুদ রঙের প্যাকেটে ‘মেড ইন সিঙ্গাপুর’ দেখিয়ে একটা জিনিস ধরিয়ে দেয় মেয়র ও বেচারা স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর হাতে! শুধু কি হলুদ প্যাকেট, সঙ্গে এনেছে একজন বিদেশি মানুষকে, তার নাম তারা বলেছে মি. লি শিয়াং; পরিচয় দিয়েছে সিঙ্গাপুরের বেষ্ট কেমিক্যালের রপ্তানি ব্যবস্থাপক (এক্সপোর্ট ম্যানেজার) এবং বিটিআই বিশেষজ্ঞ। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড নিজেদের ফেসবুক পেজে একটি সতর্কবার্তা দিয়ে বলে, তারা পাঁচ টন বিটিআই লার্ভিসাইড সরবরাহ করেনি। মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বেস্ট কেমিক্যালের নিযুক্ত কোনো পরিবেশকও নয়। এ ছাড়া মার্শাল অ্যাগ্রোভেট মি. লি শিয়াং নামে যাকে বেস্ট কেমিক্যালের রপ্তানি ব্যবস্থাপক (এক্সপোর্ট ম্যানেজার) ও বিটিআই বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করেছিল, তিনি আসলে বেস্ট কেমিক্যালের কোনো কর্মী নন। যা হয়েছে তা হয়েছে ফ্রডলি, মানে প্রতারণাপূর্ণ, অর্থাৎ পরিপূর্ণ জালিয়াতিময়।
দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ না কমার পেছনে মশা নিধনে ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত ২৩ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা যতই রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিই না কেন, মশা না কমলে দেশে ডেঙ্গু রোগীও কমবে না। সিটি করপোরেশনগুলো যেন ভেজাল ওষুধ না ছিটায় সে আহ্বান জানান মন্ত্রী।
বিটিআই জালিয়াতি নিয়ে উত্তরের সিটি মেয়র সব দোষ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপাচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়, তখন কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। এ ছাড়া প্রোডাক্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ডেলিভারি দেওয়ার সময় পিএইচপি নাম্বার, ট্রেড লাইসেন্সসহ বেশ কিছু তথ্য ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। প্রোডাক্ট রিসিভ করার সময় টেন্ডারের সব কাগজপত্র ঠিক আছে কি না বা রেজিস্টার্ড হলে তার মেয়াদ আছে কি না সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে হয়। কিন্তু ডিএনসিসি থেকে এসব কোনো কিছুই অনুসরণ করা হয়নি বলে আমরা মনে করছি।
এতসব কিছু না করে কলকাতার মশা নিয়ন্ত্রন কার্যক্রম অনুসরণ করলে এরচেয়ে ভালোভাবে মশা নিধন করা যেত বলে আমরা করে করি। ডেঙ্গু দমন শিখতে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা যাবার দরকার হয় না, ঢাকা থেকে ৩২৫ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় গেলেই শেখা যায়। ঢাকার সাথে মায়ামি বা সিঙ্গাপুরের যত সাদৃশ্য, তার চাইতে ঢের বেশি সাদৃশ্য কলকাতার সাথে। দুই শহরেই জনসংখ্যার ঘনত্ব, নগরায়ন, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য প্রায় অভিন্ন। দুই শহরেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ইতিহাসও প্রায় কাছাকাছি সময়ের।
ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ সময়েও যারা জালিয়াতি করতে পারে তাদের শুধু কালো তালিকাভুক্তিই যথেষ্ট নয়। লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। কালো তালিকভুক্ত করলেই বিচার হয়? অন্য নামে লাইসেন্স করে জালিয়াতি করবে এরা আবার। এই সোনার দেশে আরেকটা [ভুয়া] ট্রেড লাইসেন্স করে নতুন কোম্পানি খুলতে সময় লাগবে কী?
লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান।