জামায়াত-শিবিরের সাথে কমিউনিস্ট রাজনীতির মগজধোলাই

:: তানজিব রহমান ::
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আন্দোলন ও কৌশলে বরাবরের মতো হুচোট খেয়ে ভোল পাল্টে ফেলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে জিয়াউর রহমানের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠানে জামায়াতের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টানা এক বক্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চুলচেরা বিশ্লেষণের বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি সমর্থন না করলেও ‘জ্ঞানচর্চায় তাদের কর্মপদ্ধতির’ ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি মনে করেন জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক যে প্রক্রিয়া তা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত, ঠিক কমিউনিস্ট পার্টির মতো যেখানে তারা প্রচুর পড়াশুনা করে। তার এ বক্তব্যে দুটি বিষয় নিয়ে বিপত্তি বাধে।

প্রথমত, জামায়াত-শিবির বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের নাম যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধীতা করে এবং মানবতা বিরোধী অপরাধে তাদের শীর্ষ নেতাদের সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হয়। যারা ছিল ছাত্র সংঘ আল বদর আল শামস বাহিনীর জনক। দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট পার্টি মূলত বাম ঘরানার রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপি’র মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হয়ে কীভাবে দুটি আদর্শকে মিলিয়ে ফেললেন? ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পাকিস্তান পন্থী জামায়াতের সাথে বিএনপি’র একটি ঐতিহাসিক সখ্যতা রয়েছে।
লন্ডন ভিত্তিক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক ও লেখক এন্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ রক্তের ঋণ’ বইতে লিখেছেন, অসময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছিল বিএনপি। তিনি লিখেছেন- জিয়ার বিএনপি পাকিস্তানী দালালদের জন্য সবকটা সদর দরজা খুলে দিয়েছিলো। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জিয়ার দলের ২৫০ জনই ছিল দালালগোত্রের সদস্য। যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত, যারা বঙ্গবন্ধুর আমলে পাকিস্তানের শাসকচক্র ও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছিল এবং দালাল আইনে অভিযুক্ত ছিল। জেনারেল জিয়া তার মন্ত্রীসভাকে এমন ভাবে সাজিয়েছিলেন যেখানে পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন দালাল শ্রেণী ও মুক্তিযোদ্ধের বীর সেনানীরা একই সঙ্গে বসে দেশের ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণ করেছিলেন যা অত্যান্ত দুর্ভাগ্যজনক। তবে জিয়ার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে এ অধ্যায়ের একটা পরিসমাপ্তি হয়। কেননা পাকিস্তানপন্থী আর পাকিস্তান বিরোধী ধারা একই সাথে চলতে পারে না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমান সময়ে এসেও যে বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে নিজের দলভারী করবার জন্য তিনি জামায়াত-শিবিরের পড়াশুনাকে বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন অথচ বাস্তবে তা কতটা বিজ্ঞান সম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন একাত্তর সালে ভয়ঙ্কর ‘ছাত্র সংঘ’ থেকে কিভাবে নাম পাল্টে ‘ছাত্র শিবির’ হয়েছে তা অবশ্য মির্জা সাহেবের ভালো মনে থাকার কথা। ‘১৯৭২ সালের দালাল আইন’ ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে বাতিল করে দেন প্রয়াত জিয়াউর রহমান। দালাল আইন বাতিলের ফলে জেলে আটক প্রায় সাড়ে ১০ হাজার রাজাকার সে সময় মুক্তি পেয়ে যায়। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের মুক্ত করে দেয় সাবেক এ সামরিক সরকার। এছাড়া যেসব রাজাকার পাঁচ বছর ধরে পালিয়ে ছিল তারাও তখন বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে আসে। এ সুযোগে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয় জামায়াত। তাদের পুরনো ‘ছাত্রসংঘ’কে নতুন করে ঢেলে সাজাতে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয়রা মিলিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সংগঠনটির কার্যক্রম প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। রাজনীতির মাঠে প্রকাশ্যে নামার প্রস্তুতি নেয় ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ নামের দেশবিরোধী সংগঠনটি। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ছাত্র সংঘের নতুন নাম হয় ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির’। শুধু ‘সংঘ’ বাদ দিয়ে ‘শিবির’ যুক্ত করা হয়, আর সবকিছুই একই থাকে। পতাকা, মনোগ্রাম সবই এক। প্রশিক্ষণব্যবস্থা, এমনকি জেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত নেতৃত্ব-কাঠামো সবই এক থাকে। মীর কাশেম আলীকে সভাপতি ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে জামায়াতের এই ছাত্র সংগঠন নতুন কার্যক্রম শুরু করেছিল যারা ইতিহাসের বর্বরতম মানবতা বিরোধী অপরাধে সাজা ভোগকারী।
১৯৭৬ সালে যখন জামায়াত রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করে তখন জামায়াতের নীতি নির্ধারকদের মনে এই ভয় ছিল যে, ছাত্র সংঘ নামটাকে হয়তো এ দেশের মানুষ একাত্তরে তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য ভুলে যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তারা ছাত্র সংঘের ‘সংঘ’ কেটে সেখানে ‘শিবির’ যোগ করে দেয়। এ ছাড়াও জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের হিংস্র এবং পৈশাচিক কার্যকলাপ বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা স্থায়ী ঘৃণার ভাব সৃষ্টি করেছে। জামায়াত তখন ভালো করেই জানতো এই ঘৃণাটা কখনো দূর হবে না। ইসলামী ছাত্র সংঘের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে আলবদর বাহিনীর কথা চলে আসবে। ফলে সংগঠনের প্রচার-প্রচারণা বাধাগ্রস্ত হবে। আর যদি কখনো স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তখন আইনগতভাবে ফেঁসে যেতে পারে ইসলামী ছাত্র সংঘ। সেক্ষেত্রে যাতে সংগঠনের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য জামায়াতের নেতৃবৃন্দ সংঘ নামটি কেটে ফেলে শিবির যোগ করে দেয় হয়ে যায় ‘ছাত্র সংঘ’ থেকে ‘ছাত্র শিবির’।
আর এই ছাত্র সংঘের বর্তমান রূপ ছাত্র শিবিরের পড়াশুনার তারিফে বিএনপি মহাসচিব কমিউনিস্টদের সাথেও তুলনা করতে ছাড়লেন না। অথচ তিনি ভুলে গেলেন একাত্তরে এই ছাত্র সংঘ কতটা ভয়ঙ্কর ছিল পাকিস্তান প্রেমে মত্ত হয়ে কত শত মায়ের বুক খালি করেছিল। ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তার সহযোগী হিসেবে আল-বদর, আল-শামস হয়ে এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে। বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমিতে নিয়ে পশুর মতো জবাই করেছে। জিয়াউর রহমান সেই জামায়াতে ইসলামকে রাজনীতি করার অনুমোদন দিলে ছাত্রশিবির নামে তাদের ছাত্র সংগঠন মাঠে নামে। যারা এখন মির্জা সাহেবদের পাঠ্য আদর্শ হিসেবে প্রভাবিত করবার ক্ষমতা রাখেন! ছাত্র সংঘ, ছাত্র শিবির, জামায়াত যেসব বইপুস্তক পড়ে বা পাঠ করায় সেগুলো তাদের দলীয় নেতাদের লেখা বইপুস্তক। গোলাম আযমের লেখা বই পড়ে ছাত্রশিবিরের একজন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের নেতা বা কর্মী যদি নিজেকে রাজনৈতিক প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ভাবতে শুরু করেন এবং দুনিয়ার তাবৎ গবেষণা গ্রন্থকে মিথ্যা কিংবা বিভ্রান্তিকর বলে মনে করেন। তাহলে বলতে হবে এসব প্রশিক্ষণ কিংবা বইপুস্তক পাঠের ফলাফল মোটের ওপর মগজধোলাই ছাড়া আর কিছুই না।
মাও সে তুং, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনসহ আরও অনেক মার্কসবাদী নেতাদের লেখা কিংবা তাদের ওপর আলোচিত বই পাঠ করে কজনই বড় রাজনীতিবিদ হয়েছেন তা বলা মুশকিল। মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, কিংবা রাজনীতির অতীত বর্তমান পর্যালোচনা করা, পড়াশুনা করা, রাষ্ট্র রাজনীতির দর্শন আলোচনা, চর্চার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতির জ্ঞান অর্জনকে কেউ খাটো করে দেখছে না হয়তো। তবে তার সাথে শিবিরের মগজধোলাই পড়াশুনাকে এক করে ফেলে রাষ্ট্র রাজনীতির উন্নয়ন করা তো দূরে থাক ক্ষতি ছাড়া ভালো করার পরামর্শ হবে দুর্বধ্য।

লেখক: তানজিব রহমান, লেখক ও গবেষক।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]