জাতীয় স্বার্থ ইকুয়াল ‘=’ আমেরিকান ভিসা!

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ২ years ago

আমেরিকা অত্যন্ত ডিফিকাল্ট কূটনৈতিক দক্ষতা আর মুন্সিয়ানার সাথে কয়েক লাইনের একটি ভিসা পলিসি ঘোষণা করলো। যাকে বলা যেতে পারে ‘অন্ধকার ঘরে সাপ ছেঁড়ে দেওয়ার’ অবস্থা। ভিসা নীতির কথাগুলো আমাদের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরের মত। যা একেক ছাত্র, একেকভাবে ব্যাখ্যা করে থাকবে। আমাদের নেতারাও ইতিমধ্যে যার যার মত ব্যাখ্যা শুরু করেছেন। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিকে কীভাবে নিজেদের পক্ষের পদক্ষেপ হিসেবে দেখানো যায়, সেই চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। সবচেয়ে মজার কথা এই ভিসা নীতির ব্যাখ্যায় সবাই বিজয়ী। সরকারি দলের নেতা যেমন বিজয় দাবি করছেন; তেমনি বিরোধী দলের নেতাও। আওয়ামীলীগ বলছে এটা বিএনপির জন্য প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সবারই এস্টেটমেন্ট এমন যে, ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা।
দেশের এলিট শ্রেণির একটি বড় অংশ, বিশেষত আমেরিকার ভিসা নীতিতে যাদের নাম এসেছে- বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা, যারা যুক্তরাষ্ট্রে পরিবার পাঠিয়ে এক পা রেখে, আর অন্য পা বাংলাদেশে রেখে লুটপাটের অংশিদার। তাদের কাছে আমেরিকা প্রেমের কাছে দেশপ্রেম তুচ্ছ। জাতীয় স্বার্থ ইকুয়াল ‘=’ আমেরিকান ভিসা, এ খেলায় আমেরিকান ভিসা সাফিসিয়েন্ট থাকাই তাদের কাম্য।
ভালো নির্বাচন হয় না, এই তালিকায় এখন বাংলাদেশ। যা খুবই পীড়াদায়ক। রাজনীতি জনগণের জন্য করলে সেটা কঠিন হবার কথা না। কিন্তু রাজনীতি যদি হয় কেবল ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় গিয়ে সেটা ছেড়ে না দেয়ার প্রবল বাসনা, তাহলে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা দুরূহ। পরিচ্ছন্ন ভোটের মাধ্যমে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে টানা তৃতীয় মেয়াদে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কীভাবে নির্বাচিত হলেন? অথচ আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই এভাবে আশা করতে পারেন? বাংলাদেশের সমস্যা কি বিএনপিবিহীনতা? বিএনপি কি দেশ শাসনে অপরীক্ষিত? বর্তমান আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির রেকর্ড কি আমরা দেখিনি?
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাতারাতি বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, এমন ভাবা কঠিন। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনীতিতে পরিবর্তন হয় অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করেও আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরিতে অক্ষম। তখন আমাদের লজ্জা আছে, এ যুক্তি মানার বাস্তবতা কোথায়? নিজেদের মেরুদ- না থাকলে ধাক্কা তো খেতেই হবে।
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্ত করবেন, তারা ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মুখে পড়বেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৪ মে এই নীতি সম্পর্কে বলেছেন, এর আওতায় যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এ রকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে।
আমাদের রাজনৈতিক নেতারা স্ব-উদ্যোগে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে পারতেন, সেটা সম্মানজনক হতো। কিন্তু বাংলাদেশের সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশে আলাপ-আলোচনার সেই পরিসর কিংবা সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমাদের দেশের বিভাজনের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল সহজ নয়। তাই এখানে যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়েই হঠাৎ ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, বিষয়টি এমন সহজ নয়।
বছর দেড়েক আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- লক্ষণীয়ভাবে কমে আসে, বিরোধী দলের পক্ষে প্রায় বিনা বাধায় সমাবেশ করা সম্ভব হয়।
নিষেধাজ্ঞা কোনো দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সুখকর বিষয় নয়। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সামনে রেখে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় নিজের কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ থাকে। বাংলাদেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ডলারের প্রধানতম উৎস যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদেশগুলো। নতুন ভিসা নীতির পরোক্ষ বার্তা হচ্ছে, রপ্তানি বাজারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাও। বিগত বছরে সৌদি আরবকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানতম রেমিট্যান্স উৎস হয়ে উঠেছে। সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমে আসতে পারে। নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ অর্থাৎ এফডিআই প্রবাহে নেতিবাচক ধারা তৈরি করতে পারে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো অনুসরণ করে। ফলে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বিনিয়োগপ্রবাহ কমে আসতে পারে।
ভূ রাজনীতির ব্যাপার ইউএসএ যে কোন সময় এর চাইতে সিরিয়াস! এবং ভবিষ্যতে তাদের হস্তক্ষেপ আরও বাড়বে। সেই আলামতই বাংলাদেশের জন্য ভীসা নীতি। কোন সরকার নয়, তাদের টার্গেট বাংলাদেশ। ভবিষ্যত যে কোন সরকারকে তাদের প্রেসক্রিপশনে চলতে হবে। এতে যা ঘটবে তা স্যাংশন থেকেও মারাÍক হবে। যা গুটিকতক জন বা সংস্থা নয়, পুরো দেশের মানুষ এর আওতায় এসে যেতে পারে।
মার্কিন কূটনীতি নানা ধাঁধায় ভরা। একদিকে ধমক, অন্যদিকে দলে ভেড়ানোর কৌশল। ভিসা নীতির প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি লাইনের মাঝখানে লুকিয়ে আছে নানা বার্তা ও নানা ব্যাখ্যা। আমেরিকার চানক্য কৌশল বুঝার ক্ষমতা অতো সহজ নয়। নিষেধাজ্ঞা মূলত অঘোষিত ও আসল উদ্দেশ্য ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চেয়ে নিজেদের স্বার্থটাই মুখ্য। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে নতুন এক ঠা-া যুদ্ধে প্রবেশ করেছে।
হিরোশিমা, নাগাসাকি, আফগানিস্তান, ইরাক, কিউবা, ইসরাইল-ফিলিস্তিন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে আমেরিকার মানবাধিকার হরনের হিস্টরি কারো অজানা নয়। পশ্চিমারা মানবাধিকারের নীতিগুলোকে সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ করে না। যুক্তরাষ্ট্র তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতাকে না দেখার ভান করে, আবার কারও ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতার কিছু সত্য, তার চেয়েও বেশি অসত্য তথ্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়। মার্কিন নাগরিকদের জন্য এক রকম ব্যবস্থা, ভিনদেশিদের জন্য আরেক রকম ব্যবস্থা। আবু গারিব কারাগার কিংবা গুয়ানতানামো বে বন্দিশালায় মার্কিন সৈনিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তাদের কপটতার উজ্জ্বল সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে।
এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের নজির রয়েছে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেটা না মেনে বাংলাদেশের মানুষের উপর অত্যাচার, জুলুম শুরু করে এবং সেসব জেনে বুঝেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে; সুতরাং তখন তাদের গণতন্ত্র কোথায় ছিল? এটি সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মিত্র বাহিনীকে হুমকি দিতে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সপ্তম নৌবহর মোতায়েন করেছিল। আমেরিকাকে ভয় পেলে কি দেশ কখনও স্বাধীন হতো? হতোনা। আমেরিকার প্রতিটি কথা যদি শিরোধার্য ও অবশ্য ধর্তব্য হতো, তো ৭১ সালে বাংলাদেশ জয়ের মুখ দেখতো না। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার নামে যে যুক্তরাষ্ট্র তার একান্ত স্বার্থ হাসিলকারী, তা কে-না জানে?
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, বাংলাদেশকে চীনবিরোধী সামরিক জোট কোয়াডে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে এই স্যাংশন আরোপ। চীন-রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে কাছে টানার জন্য বা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে আরও সুবিধা পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এসব করছে।
দশকের পর দশক বাংলাদেশ থেকে টাকা লুট করে যারা আমেরিকা, কানাডা, সুইজারল্যান্ডে জমা করেছে, ভিসা নীতির এসব প্রেসক্রিপশনকারী, গণতন্ত্রের লেবাসী দেশ ও দেশগুলো আজ অবধি একজন বাংলাদেশী অর্থ পাচারকারিকে লুটের বা পাচার করা অর্থসহ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে কী? কিংবা আজ অবধি কোনো পাচারকারীকে ধরে তাদের দেশেও শাস্তি দিয়েছে? বরং বিশ্বের অন্যতম শান্তিকামী দেশ সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতির শতকরা ১০ ভাগ নির্ভর করে বিদেশীদের রাখা সুইস ব্যাংকের টাকার উপর। সুইজারল্যান্ডের সংবিধানে সে অর্থের যোগানদাতাদের পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ওইসব দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতো কঠোর, কেউ অনুমোদিত স্থানে থুথু ফেললে নিমিষে থুথু নিক্ষেপকারীকে ধরে ফেলে, সেই দেশে বা সেই সব দেশে বাংলাদেশ থেকে বস্তা ভর্তি অবৈধ টাকা নিয়ে গোপনে প্রবেশ করতে পারবে তা কি বিশ্বাস করা যায়? বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থসহ পাচারকারীদের কি এরা ধরিয়ে দেবে? যদি বাংলাদেশের পাচারকারী ও পাচারকারীদের অর্থ ফেরত দিয়ে ভিসা নীতি ঘোষণা করতো তাহলে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা খুশি হতাম।