জাতীয় পতাকা দিবস উদযাপনে উদাসীনতা কাম্য নয়

::
প্রকাশ: ২ years ago

পৃথিবীর সব সভ্য দেশেই জাতীয় দিবসগুলো সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশে জাতীয় দিবসগুলোর মধ্যে যে দিবসসমূহ মুক্তিযুদ্ধ ও মাতৃভাষার সাথে সম্পৃক্ত সে দিবসসমূহ বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালিত হয়ে থাকে; হওয়াটাই জরুরি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমাদের জাতীয় পতাকা দিবসটি ঠিক সেইভাবে দেশব্যাপী সরকারি-বেসরকারি ও সামগ্রিকভাবে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে পালিত বা উদযাপিত হতে দেখা যায় না। কিন্তু কেনো? দিবসটি তো মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। ইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায়।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

মার্চ মাস বাঙালির স্বাধীনতার মাস। এ মাসেই অকুতোভয় ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নিপীড়ন আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের জাতীয় পতাকাকে দাঁড় করাতে। আজ (২ মার্চ) তাই আমাদের ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন দিবস। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজসহ ডাকসুর নেতারা ঐদিন সর্বপ্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
জাতীয় পতাকা আমাদের স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগে ২ মার্চ সাড়া দিয়েছিল আমজনতা। প্রকৃতপক্ষে সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয় এবং স্বাধীনতা অর্জনের পথে যাত্রা শুরু করে। পতাকা উত্তোলনই জানান দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের বিকল্প নেই।

জাতীয় পতাকা উত্তোলন আমাদের ভূখ- ছাড়িয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে একটি শোষিত ও বঞ্চিত দেশের অধিকার এবং স্বাধিকার আদায়ের বিপ্লবের সূচনা ধ্বনি। দীর্ঘ ৯ মাসের বহু ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভুদয় ঘটে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস এই পতাকাই বিবেচিত হয় আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে। পরবর্তীতে সামান্য পরিবর্তন করে সংবিধানের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়।
২ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ায় সকাল থেকেই দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকার রাজপথে অবস্থান নেয়, ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম, নিগ্রহ, শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ ও জনতা পাকিস্তানের জুলুম নির্যাতন উপেক্ষা করে জানিয়ে দেয় বাঙালিরা মাথা নত করবে না।

লাল-সবুজের মাঝেই বাংলাদেশের পরিচিতি। জাতিসংঘ সদর দফতর অথবা বিশ্বকাপ ক্রিকেট, অলিম্পিক কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই লাল-সবুজ বাংলাদেশকেই ধারণ করে। বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত ওই পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলন করেছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা আ স ম আব্দুর রব। তখন ছাত্র সমাবেশের নেতৃত্বে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম নিজ হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে ধানম-িতে তার নিজ বাসভবনে। এছাড়া একাত্তরের এই দিনেই (২ মার্চ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভার ঘোষণাও দেয়া হয় এই দিনে।
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনের প্রধান এম হোসেন আলী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এটিই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে বর্তমান মুজিব নগরের আ¤্রকাননে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে সর্বপ্রথম জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পতাকার মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে লালবৃত্ত সংযোজন করা হয়, যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক ও স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের স্মৃতি বহন করে। মানচিত্রটি পতাকার উভয় পাশে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার সমস্যার কারণে পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়। পতাকার মাপ, রং ও তার ব্যাখ্যাসম্বলিত একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয় চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানকে। শিল্পী কামরুল হাসানের ডিজাইনে পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
তখন পতাকার আকার ও রং কী হবে, তা ছাত্রনেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা হয়। শাজাহান সিরাজের প্রস্তাবে পতাকার মধ্যে লাল রং, আ স ম আবদুর রবের মতামতে জমিন সবুজ, মার্শাল মণির মতে গাঢ় সবুজ রং ও কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানচিত্র বসানো হয়। শিবনারায়ণ দাস পতাকার ডিজাইন তৈরি করেন। ছাত্রনেতা খসরু নিউমার্কেট থেকে কালি, তুলি ও কাপড় কিনে আনেন। পতাকাটি সেদিন পেঁচিয়ে রেখে দেয়া হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে। এই পতাকাটিই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়ানো হয়েছিল।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সকল দিবসে সাধারণ মানুষের উত্তোলন করা আইনত অপরাধ। তবে জাতীয় পতাকা যে সকল দিবসে উত্তোলন করা যাবে তা হলো স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, বিজয় দিবসসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত অন্য যে কোনো দিবসে। এছাড়া যে কোনো দিবসে এই প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা যে ১৫টি বাসভবনে উত্তোলন করা যাবে তা হলো Ñ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, বিদেশে বাংলাদেশের কূটনীতিক এবং তিন পার্বত্য জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান।

ব্যক্তিগত গাড়ি, জলোযান ও বিমানে জাতীয় পতাকা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ও বিদেশে নিযুক্ত কূটনীতিকরা ব্যবহার করতে পারবেন। জাতীয় পতাকা যে সকল দিবসে অর্ধনমিত থাকে তা হলোÑ ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ অথবা সরকার কর্তৃক অন্য যে কোনো দিবসে।

অত্যন্ত পরিতাপ ও বেদনার বিষয় এই মহান দিনটি (২মার্চ) সরকারি দপ্তর, পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে প্রচারের মাধ্যমে যৎসামান্য পালিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য দিবসসমূহ যেভাবে পালিত ও উদযাপিত হয়, তেমনিভাবে আড়ম্বরপূর্ণভাবে মহান জাতীয় পতাকা দিবসটি পালিত হয় কি?

লেখক: বিলাল হোসেন মাহিনী, নির্বাহী সম্পাদক, ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net