পাকিস্তান মিলিটারির মিডিয়া ফোরাম ‘দি ডিফেন্স.পিকে’ এর ভিন্নমাত্রিক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফর পিস অপারেশনস জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স আগামী ২৫-২৬ জুন বাংলাদেশ সফর করবেন। ২০২৩ সালের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের প্রস্তুতি মূলক বৈঠকে এটাই হবে তার প্রথম বাংলাদেশ সফর। কানাডা ও উরুগুয়ে ছাড়াও এই আসরের অন্যতম সহ-আয়োজক বাংলাদেশ।
এটি ঢাকার জন্য একটি “সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ” সফর হবে, কারণ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকটি পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের অংশগ্রহণে দ্বিবার্ষিকভাবে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পর্যায়ের ইভেন্ট।
ল্যাক্রোইক্সের বাংলাদেশ সফরের কারণ কী?
জঁ-পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স হলেন শান্তি অভিযানের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি বহুপাক্ষিক সংস্থা এবং জাতিসংঘের ক্রিয়াকলাপ এবং প্রোগ্রামগুলিতে ফোকাস সহ ২৫ বছরেরও বেশি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন। জনাব ল্যাক্রোইক্স ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার এবং ফ্রাঙ্কোফোনির পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ভবিষ্যতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের আরও অঙ্গীকার অর্জনের লক্ষ্যেই ল্যাক্রোইক্সের ঢাকা সফর। কিছু সদস্য রাষ্ট্র তাদের শান্তিরক্ষীদের ফিল্ড মিশন থেকে সরিয়ে নেওয়ায় জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে আরও সেনা মোতায়েনের চেষ্টা করছে। তিনি এমন এক সময়ে সফর করছেন যখন ঢাকা ও বিদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী প্রধান তার আসন্ন সফরে বাংলাদেশ থেকে আরো শান্তিরক্ষী নেয়ার অঙ্গীকার করবেন বলে আশা করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই উৎসাহব্যঞ্জক ও ইতিবাচক।
এই পরিদর্শনকে লক্ষ্য করে দোষারোপের খেলা
ল্যাক্রোইক্সের সফরের কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন দেশবিরোধী শক্তি প্রচার করছে যে, জাতিসংঘ মিশন সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে একটি নেতিবাচক বার্তা দিতে মিঃ ল্যাক্রোইক্স বাংলাদেশে আসছেন। তবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী প্রধান বাংলাদেশ থেকে আরও শান্তিরক্ষী নেয়ার অঙ্গীকার করছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রধান হিসেবে তার এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর সৈন্য ও পুলিশ প্রেরণকারী দেশ।
নির্বাচনের আগে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা রয়েছে। চলছে নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফর পিস অপারেশনস জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি সফর করবেন তখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে “প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করুন”। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও উল্লেখ করেছে যে, জাতিসংঘের উচিত বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের র্যাবের সাথে পূর্ববর্তী মোতায়েনের তথ্য প্রকাশ করা, তারপরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে র্যাবের সাথে সম্পর্কিত কাউকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিষিদ্ধ করা। এইচআরডাব্লিউ কীভাবে এমন একটি মিথ্যা চিত্র উপস্থাপন করেছিল তা এখনও একটি বিস্ময়কর সত্য!
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এইচআরডব্লিউ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কয়েকটি ভুল তথ্য প্রচারণার সাথে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিল। যুদ্ধাপরাধী চক্রটি ওই সময় তাদের বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদান দিয়েছে বলে অভিযোগ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এবং সর্বোচ্চ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছে। কিন্তু তারপরও এইচআরডব্লিউ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ নিয়ে অভিযোগ করে যাচ্ছে। এরপর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উত্থাপন করে এবং একের পর এক অভিযোগ করতে শুরু করে। ২০২১ সালে ব্যক্তিগত কারণে গাইবান্ধায় বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে থাকা তোহা আদনানের জোরপূর্বক নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রকাশ করে এইচআরডব্লিউ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এগুলো রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক তদবিরের ফল।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে ব্যাপকভাবে সম্মানিত। এইচআরসি এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর এই অযৌক্তিক ও অবাস্তব অভিযোগ বাংলাদেশের মতো একটি দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়, যা তার গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী আংশিকভাবে প্রশংসনীয়। তদুপরি, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার এইচআরসির প্রস্তাবের কোনও মানে হয় না। এটি ও প্রমাণ করে যে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অপমান করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
জিন-পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের কাছ থেকে প্রত্যাশা
গত ১৪ জুন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চিফ অ্যাডভোকেসি অফিসার ব্রুনো স্ট্যাগনো উগার্তে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী প্রধানের বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পরামর্শ দেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ প্রায় সব সার্বজনীন মানবাধিকার চুক্তিতে অংশ নিয়েছে। যেহেতু দেশে বৈদেশিক নিপীড়ন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই জাতি হিসেবে বাঙালি সারা বিশ্বে অধিকার ইস্যুতে সহানুভূতিশীল। সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদেও একই চেতনা কে সমুন্নত রাখা হয়েছে, যা নিরস্ত্রীকরণ, জাতিসংঘের মানবাধিকার এবং বিশ্বের যে কোনো স্থানে নিপীড়নের নিন্দা জানানোর মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির প্রতি বাংলাদেশের বিশ্বাসপুনর্ব্যক্ত করে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্ববৃহৎ সৈন্য সরবরাহের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তিতে অবদান রাখছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। বিগত ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা সুনাম, ভালোবাসা, কৃতিত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে বিশ্ব মানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। মর্যাদাপূর্ণ অবদানের কারণে ল্যাক্রোইক্স বাংলাদেশ থেকে আরো সৈন্য পাঠানোর অঙ্গীকার করছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ইউনিফর্মধারী সৈন্য প্রেরণে শীর্ষ অবদানকারী দেশ। বর্তমানে নয়টি শান্তিরক্ষা মিশনে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৬৬ জন শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন। আশা করা যায়, এই শীর্ষ সরকারি বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা সম্পর্ক সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।
উল্লেখ্য, এই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক দু’পক্ষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সর্বোত্তম সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এই বৈঠক সফলভাবে সম্পন্ন করতে হবে। বাংলাদেশ আশা করে, এই সফর বাংলাদেশ-জাতিসংঘ সম্পর্ককে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং আমাদের বিদ্যমান সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।
লেখক: ইরিনা হক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট।