জাতিসংঘের ইকোসকে বাংলাদেশের উন্নয়ন-সফলতার বৈশ্বিক স্বীকৃতি

:: মেহরাব আল মামুন ::
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে

বিশ্বব্যাপি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠাকালীন ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত হলেও বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৯৩। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত জাতি সংঘের সদর দপ্তর বিশ্বের কাছে শান্তি, সাম্য, মর্যাদা ও শান্তিময় পৃথিবীর বার্তা দিয়ে আসলেও প্রায় অনেক দিক থেকেই জাতিসংঘ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সফল হতে পারছে না। যুদ্ধ-সংঘাত, জাতিগত নিধন, গণহত্যা যেন বিশ্বময় উৎকন্ঠা তৈরি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘের প্রধান ছয়টি অঙ্গ সংস্থা রয়েছে। যারা বিশ্বে তাবৎ পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করে। ছয়টি অঙ্গ সংস্থা হলো- সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ইকোসক), সচিবালয়, অছি পরিষদ ও আন্তর্জাতিক আদালত।

বাংলাদেশ এ বছর ৭জুন জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংস্থা ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ বা Economic and Social Council (ECOSOC) of United Nations এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। ১৮৯ ভোটের মধ্যে ১৮১ ভোট পেয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রার্থী হিসেবে ইকোসক সদস্য নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। নির্বাচনস্থলে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকবৃন্দ বাংলাদেশের বিজয়কে “বাংলাদেশের উন্নয়ন-সফলতার বৈশ্বিক স্বীকৃতির অংশ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একই অঞ্চল থেকে এ বছর বাংলাদেশ ছাড়াও সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা ও উজবেকিস্তান এ নির্বাচনে জয়লাভ করে। জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি ডেনিস ফ্রান্সিসের সভাপতিত্বে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৫-২০২৭ মেয়াদে বাংলাদেশ ইকোসক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।

এক নজরে ইকোসকঃ জাতিসংঘের প্রধান ৬টি অংগ সংগঠনের একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল যাকে সংক্ষেপে ইকোসক (ECOSOC) বলে; যা বিশ্বের ১৯৩টি সদস্য দেশসমূহের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলির পাশাপাশি মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বময় কাজ করে । এটি জাতিসংঘ এবং বিশেষায়িত সংস্থাগুলির কাজের সমন্বয়ও করে। প্রতি বছর দুবার একমাস ব্যাপি নিউইয়র্ক ও জেনেভায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অধিবেশন বসে। এ পরিষদের সদস্য দেশ ৫৪টি। প্রতিবছর ১৮টি রাষ্ট্র বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তিন বছর মেয়াদে এর সদস্য নির্বাচিত হন। এর ৫টি আঞ্চলিক কমিশন রয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ন অঞ্চল, ইউরোপ, ও আফ্রিকা অঞ্চল এ ৫টি আঞ্চলিক কমিশন নিয়ে ইকোসক গঠিত এ বছর বাংলাদেশ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।

ইকোসক বিশ্বময় যেভাবে কাজ করেঃ টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) জন্য জাতিসংঘের ভ্রাতৃ সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা, নীতি নির্ধারণী, প্রস্তাবাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ইকোসক) উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা ও কার্যক্রমের অগ্রাধিকার নির্ধারণে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। মানুষের জীবনে প্রকৃত উন্নয়ন ও ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য ইকোসকের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে বিশেষজ্ঞ প্যানেল, পরামর্শক, অর্থনৈতিক তহবিল গঠনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সহায়তায় সমস্যার মূল চিহ্নিত করণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে কাজ করে থাকে।

বাংলাদেশ যেভাবে উপকৃত হবেঃ বাংলাদেশ জাতিসংঘের ২০৩০ এজেন্ডা(এসডিজি) ও ভিশন-২০৪১ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ বাস্তবায়নে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে চলার পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যার কূটনৈতিক ফল বাংলাদেশের উন্নয়নের বৈশ্বিক স্বীকৃতি। বস্তুত, বাংলাদেশ যে অন্যান্য দেশের বিশ্বাস, নির্ভরতা ও সম্মান অর্জন করেছে বৈশ্বিক নির্বাচনে ১৮৯টি দেশের সমর্থন অত্যন্ত সম্মানজনক আর এ সাফল্য তারই স্বীকৃতি। ইকোসকের সদস্যপদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইকোসকের আওতাধীন বিভিন্ন ফোরাম, কমিশন, কমিটি, নির্বাহী বোর্ড ও আঞ্চলিক ফোরাম যেমন ইউএনএসকাপ এর সাথে এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে এবং বাংলাদেশের সর্বোত্তম উন্নয়ন অনুশীলনসমূহ বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারবে। ইকোসকের উন্নয়ন নীতিমালা বিষয়ক কমিটি সিডিপি (Committee for Development Policy- CDP) তিনটি সূচকের ভিত্তিতে তিন বছর পরপর উন্নয়নশীল দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়ে পর্যলোচনা করে। এ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী একটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবার সুযোগ লাভ করে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে ইকোসকের সদস্যপদ অবাধ ও টেকসই উত্তরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সিডিপি কর্তৃক স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার সূচক গুলো হচ্ছে: ১. মাথা পিছু আয় (Gross National Income Per Capita)- যা বিগত তিন বছরের গড় মাথা পিছু জাতীয় আয় হতে নির্ধারণ করা হয়। ২. মানবসম্পদ সূচক (Human Asset Index)- যা পুষ্টি, স্বাস্থ্য, মৃত্যুহার, স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষার হারের সাথে সমন্বয়ে তৈরি হয়। ৩. অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক (Economic Vulnerability Index) যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অভিঘাত, জনসখ্যার পরিমাণ এবং বিশ্ববাজার থেকে একটি দেশের দূরত্বসহ আটটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। উপরোক্ত যে কোন দুটি সূচকের মান অর্জন করতে পারলে, বা পর পর দুটি বার্ষিক পর্যালোচনায় (৬ বছর) তিনটি সূচকের যে কোন দুটিতে উত্তীর্ণ হলে অথবা মাথাপিছু আয় নির্ধারিত মানের দ্বিগুণ অর্জন করতে পারলে তাকে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশে ইকোসকের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারবে। ইকোসকে আগামী তিনবছর মেয়াদে (২০২৫-২০২৭) বাংলাদেশ দায়িত্ব পালন অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসবে। এই বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ২০২৫-২০২৭ মেয়াদে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্লাটফর্মে এবং বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম ইকোসকে তার দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করল। উল্লেখ্য,এর আগে ১৯৭৬-১৯৭৮ সাল এবং ১৯৮১-১৯৮৩ সাল, ২০২০-২০২২ সাল পর্যন্ত তিন’বার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ইকোসক) এর সদস্য হিসেবে কাজ করে।

ইকোসকে বিপুল ভোটে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভকে বৈশ্বিক কূটনীতিকরা মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও সৃষ্টিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ বলে অবিহিত করছেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ বর্তমানে ইউএনডিপি,ইউএনএফপিএ, ইউএন অপ্স-এর নির্বাহী বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। তাই বলা যায় জাতিসংঘের ইকোসকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আগামী দিনে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা ২০৩০ অর্জনে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: মেহরাব আল মামুন, গবেষক ও লেখক।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]